বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের স্বনামধন্য আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত জনস্বার্থে মামলাসহ আইন শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের বিশেষ প্রতিনিধি প্রিন্স মাহামুদ আজিমের নেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে। বিশেষ এই সাক্ষাৎকার ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : শুরুতেই আপনার শৈশব কিশোর, পড়াশুনা এসব বিষয়ে জানতে চাই…
অমিত দাশ গুপ্ত : ধন্যবাদ আপনাকে। আমার জন্মস্থান বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে। আমার বাবা নিহির দাস গুপ্ত। তিনি রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী এবং সর্বোপরি একজন বীর মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল, গোপালগঞ্জ এবং ফরিদপুর অঞ্চলে খুব সক্রিয় একটা বাহিনী হেমায়েত বাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। আমার বাবা ছিলেন সেই বিখ্যাত হেমায়েত বাহিনীর প্রধান সংগঠক। শৈশব থেকে বাবার চেতনাগত বিষয়গুলোকে আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তাই বুঝ হওয়ার পর থেকেই বাবার চেতনাগত বিষয়গুলোকে আমার চরিত্রে ধারণ করি যা বর্তমানেও আমার মাঝে বিদ্যমান। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও পার্শ্ববর্তী জেলা মাদারীপুরে অবস্থিত ডি.কে.আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমী এন্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করি। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ভর্তি হই। তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বিতর্ক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। সে সময় ডাকসু ছিল না, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্রিয়াশীল সংগঠন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংগঠন। সে সংগঠনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আমি ১৯৯৯ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে সফলতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে আইন পেশাকেই বেছে নিই। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলর থেকে সনদপ্রাপ্ত হয়ে আইনজীবী তাপস কুমার দত্তের জুনিয়র হিসাবে ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনে আমার পেশাগত জীবন শুরু করি। পরবর্তীতে ২০০৫ সাল থেকে ব্যারিস্টার তানভীর পারভেজের জুনিয়র হিসাবে উচ্চ আদালতে প্র্যাকটিস শুরু করি। এরপর ২০১০ সাল থেকে নিজে ওকালতি শুরু করি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে প্র্যাকটিস করার অনুমতিপ্রাপ্ত হই। এখন আমি আপিল বিভাগেও মামলা পরিচালনা করতে পারছি। এর পাশাপাশি আমি ২০০৬ সাল থেকে ঢাকা সিটি ল’কলেজের সাংবিধানিক আইন ও বাণিজ্যিক আইনের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবেও কাজ করছি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : আমরা জানি ইতিমধ্যে আপনি অনেকগুলো জনস্বার্থে মামলা করেছেন এবং সফলতাও আছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পাঠকদের আপনার মাধ্যমে জানাতে চাই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং জনস্বার্থে মামলা বলতে কি বুঝায়?
অমিত দাশ গুপ্ত : প্রথমেই বলতে চাই, দেশের কোনও নাগরিকের মৌলিক অধিকার কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে তাকে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বলা হয়।
আর জনস্বার্থে মামলা বলতে যিনি মামলা করছেন তিনি তার জন্য নয় বরং যে সকল সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে অথচ আদালতে আসতে পারছেন না তাদের পক্ষ হয়ে আইনি লড়াই করাটাই হচ্ছে জনস্বার্থের মামলা।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : তার মানে রিটের ক্ষেত্রে জনস্বার্থে মামলার ব্যাপকতা অনেক…
অমিত দাশ গুপ্ত : জনস্বার্থে মামলার ক্ষেত্রে যিনি মামলা দায়ের করছেন তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সংক্ষুব্ধ নাও হতে পারেন কিন্তু সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে তিনি নিজেকে সংক্ষুব্ধ মনে করতে পারেন। আমাদের পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানে আগে জনস্বার্থে মামলার প্রচলন হয়, পরবর্তীতে বাংলাদেশেও জনস্বার্থে মামলার শুরু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনস্বার্থে প্রথম মামলাটি হচ্ছে কাজী মোখলেছুর রহমান বনাম বাংলাদেশ। এটি আইন বিষয়ক মাসিক সাময়িকী ঢাকা ল’ রিপোর্টস (২৬ ডি.এল.আর, সুপ্রিম কোর্ট) এ লিপিবদ্ধ করা আছে। আদালত কর্তৃক ঘোষিত সে রায়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত একটা চুক্তি হয়েছিলো। সেটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিলো যে এটি অবৈধ। দেশের কোন ভূখণ্ড বিনিময় করা যায় না মর্মে মামলাটি তখন খারিজ হয়ে যায়। রায়ে আদালত একটা পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। যে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পরবর্তীতে সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী করতে সরকার বাধ্য হন। অর্থাৎ তার মামলা খারিজ হয়েছে কিন্তু তিনি যে কারণে মামলাটি করেছেন সেটি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পরবর্তীতে পার্লামেন্ট গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশে প্রথম জনস্বার্থে মামলার সূচনা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে বিকশিত হয়ে আজকে জনস্বার্থে মামলা আমাদের দেশে স্বীকৃত একটা আইনি পন্থা। যেখানে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যিনি বা যারা তারা আসছেন না কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে অন্য কেউ মামলা করছেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : দেশে জনস্বার্থে মামলার ক্ষেত্রে আপনি তো একজন তারকা আইনজীবী। জনস্বার্থে মামলা করার এই চিন্তা কবে, কীভাবে এলো?
অমিত দাশ গুপ্ত : আমি ব্যক্তিগত ভাবে সৌভাগ্যবান যে আমি অনেকগুলো জনস্বার্থে মামলা পরিচালনা করতে পেরেছি এবং এখনো করছি। আর এর সূচনা হয় মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের সময়কার একটা ঘটনা থেকে। তখন মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ চলছে আমি আমার পরিবারকে সাথে নিয়ে ঐ নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় উপর থেকে একটা পাথর জাতীয় কিছু পড়ে আমার গাড়ির পিছনের গ্লাস ভেঙ্গে যায়। আমি গাড়ি থেকে নেমে এর প্রতিবাদ করায় তারা ক্ষতিপূরণ দিতে চায়। তখন আমি ওদের এই খামখেয়ালী কাজের শাস্তি হিসাবে ক্ষতিপূরণ নিয়ে চলে আসি। ঘটনাটা হয়তো আমি ভুলে যেতাম কিন্তু তার দুইদিন পরই মগবাজার ঐ নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারে কাজ করা অবস্থায় এক নির্মাণ শ্রমিক পড়ে গিয়ে মারা যান। তার মানে ঐ নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিক কিংবা পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছিলোনা। তখন আমার মনে হল, এইভাবে যদি চলতে থাকে তবে আরও দুর্ঘটনা হতে পারে। এই চিন্তাবোধ থেকে ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে তার জন্য নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে সর্বপ্রথম জনস্বার্থে মামলা দায়ের করি। তখন উচ্চ আদালত রুল ইস্যু করেন এবং নির্দেশ দেন নির্মাণ কাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : জনস্বার্থে করা আপনার একটি উল্লেখযোগ্য মামলার কথা বলুন…
অমিত দাশ গুপ্ত : সাম্প্রতিক আমার একটি জনস্বার্থে দায়ের করা মামলা হচ্ছে চুয়াডাঙ্গায় বিনামূল্যে চক্ষু শিবিরে চোখের চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় ও দরিদ্র বিশজন সাধারণ মানুষের একটি করে চোখ ভুল চিকিৎসার কারণে সারাজীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। পত্রিকার পাতায় খবরটি পেয়ে আমি চক্ষু শিবিরে চোখের চিকিৎসা নিতে এসে অন্ধ হয়ে যাওয়া অসহায় বিশজন মানুষের পক্ষে জনস্বার্থে মামলা করি। উক্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেন। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় মাহামান্য আপিল বিভাগও বহাল রাখেন। এখানে আমার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ না থাকলেও অসহায় মানুষগুলো আমার করা জনস্বার্থের মামলার ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাওয়ার জায়গাটা আমার জন্য অনেক বেশী আত্মতৃপ্তির ছিল।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : বলা যায় আপনি একজন সফল আইনজীবী; আবার দীর্ঘদিন আইনের শিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন। তাই আইন শিক্ষার্থীদের আপনার পরামর্শ কি?
অমিত দাশ গুপ্ত : আইন বিষয়টা একটি মহৎ বিষয়। কারন আইনের সাথে জনগনের প্রত্যক্ষভাবে নিবিড় এক সম্পৃক্ততা রয়েছে। অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারা আইন নিয়ে কাজ করেন তারা সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সর্বসাকুল্যে যারা আইনের শিক্ষার্থী তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, আইন বিষয়টাকে আত্মস্থ করা। পুরো আইন মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। আইন কোথায় আছে, কি আছে সেটিকে অনুধাবন করা আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : আমরা আশা করবো আপনার এই সকল গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ আইন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করবে। সে সাথে যারা আইন বিষয়ে পড়াশুনা সম্পন্ন করেছেন কিংবা নবীন আইনজীবী তাদের কি ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং উত্তরণের উপায় কি?
অমিত দাশ গুপ্ত : আইন বিষয়ে পড়াশুনার সম্পন্ন করার পর যারা আইনজীবী হতে চায় তাদের প্রথম কয়েক বছর অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কারন এই সময়ে শুধু ঐ শিক্ষার্থীর সনদ ব্যতীত কোন প্র্যাক্টিকেল অভিজ্ঞতা থাকে না। যার ফলে তাকে কাজগুলো শিখে নিতে হয়। যদি সে প্রকৃতভাবে আইন বিষয়টাকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে শিখতে চায় তবে এই শেখার সময়টায় তার জন্য কোন উপার্জনের ব্যবস্থা থাকে না। তাই নবীন আইনজীবীরা প্রথম ধাপে কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এই কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলে উপার্জন তখন এমনিতেই চলে আসে। সুতরাং আইন শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ধৈর্য্য ধরে তারা যদি লেগে থাকে সাফল্য একদিন আসবেই আসবে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : শত ব্যস্ততার মাঝে ল’ইয়ার্স ক্লাব ডটকমকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অমিত দাশ গুপ্ত : ল’ইয়ার্স ক্লাব আমার খুব প্রিয় একটি অনলাইন পত্রিকা। ল’ইয়ার্স ক্লাবের মাধ্যমে আইনাজ্ঞনের অনেক খবর জানতে পারি। তাই আমি ল’ইয়ার্স ক্লাবকে ধন্যবাদের পাশাপাশি সফলতা কামনা করি।