আরাফাত বিন আবু তাহের
সতের কোটির দেশে চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড একের পর এক ঘটেই চলেছে। এদিকে একেকটা অঘটনের পর কয়েকদিন হই-চই হয়, মিছিল-মিটিং হয়, সভা সেমিনারে চোখ ডলে রোদনের চেষ্টা চলে, আবেগের জোয়ারে ফেসবুক ভাসিয়ে স্ট্যাটাস দেন জনতা। দিন কয়েক পরে আবেগের নদীতে ভাটা পড়ে গেলে সবাই সর্বশান্তের মত চুপসে যান। কর্মব্যস্ত মানুষজন বেমালুম ভুলে যান দিন কয়েক আগের ভীতিজাগানিয়া হত্যাকান্ডগুলোর কথা।
কয়দিন বাদে আবারও যখন কেউ নির্মমতার শিকার হন, কোথাও আগুন লাগে, কোন বিপর্যয় হয়, তখন আবার শুরু হয় একই রকম প্রতিক্রিয়ার। আবার আবেগের জোয়ার ওঠে। লোকজন ফেসবুকে বুক চাপড়িয়ে স্ট্যাটাস দেন, অনেক সভা সেমিনার করেন। এভাবে অনেক কথা, অনেক আবেগের সংক্রমণ ঘটানোর পর, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ চালাচালির পর স্বজন হারানো সর্বশান্ত পরিবারগুলোর খোঁজও আর কেউ রাখেন না। সময়ও হয়ে ওঠে না আমাদের। হায়রে ব্যস্ত জীবন ব্যবস্থা!
তবে আমি এখানে ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করতে বসিনি। আমার লেখাটি শেষ না করে আবার কেউ ভাববেন না আমি প্রত্যেকটা ঘটনার পর সর্বসাধারণের এমন অসাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিরোধিতা করছি। আজকে এখানে আমি কথা বলব একই সাথে অন্য একটি প্রসঙ্গে-
আমরা লক্ষ্য করেছি, সর্বসাধারণ প্রত্যেকটা ঘটনার পরপরই আইন শৃংখলার অবনতি হয়েছে মর্মে দোষারোপের পাশাপাশি আদালতের বিচার ব্যবস্থার প্রতিও একধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান। বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আবিষ্কার করেন প্রত্যেকবার নতুন করে। আদালতের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন মস্তকের উপর খড়গ উত্তোলনের মত ভয়ানকভাবে। আদালতের অতি আদালতপণাকে নিয়ে আদাখেঁচড়া করে হা হুতাশ করেন, বুক চাপড়ে খোদার কাছে নালিশ জানান। তাদের ‘হে বিচারপতি তোমারও বিচার হবে একদিন’ এমন আবেগাক্রান্ত কথায় আমরাও আক্রান্ত হই, বিচারক হিসাবে আমাদেরও চোখের জলবিয়োগ ঘটে বৈকি! কিন্তু বিশ্বাস করুন, প্রাচীন ব্রিটিশ আমলের এডপ্ট করা বিচার ব্যবস্থায় আমাদের এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই, করারও নেই। বিচারক মিছিলের স্লোগান শুনে ফাঁসির কাষ্ঠে আসামীকে ঝুলিয়ে দিতে পারেন না। রাতে ফেসবুকের রোদন দেখে দিনে এজলাশে কোপন স্বভাব শো করতে পারেন না।
ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা চলে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিকে অক্ষরে অক্ষরে পালনের মধ্য দিয়ে। এর থেকে এক চুল নড়লেই পুলসেরাতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চুলের মত পুল ফসকে বিচারককেও নিমজ্জিত হতে হয় অহেতুক শোকজ থেকে শুরু করে চাকুরি হারানোর মত বিরূপ শাস্তির নরকে। কারণ আইন কানুনের নথিমূলের নির্দেশনা ইনটোটো ফলো করে চলতে হয় বিচারককে। এখানে আবেগের আতিশয্যে গা ভাসিয়ে রাতারাতি রায় প্রসবের কোন সুযোগ নেই। এই যে হালফিলের কুখ্যাত নবাব (অধ্যক্ষ) সিরাজুদ্দৌলা কারাগারে আছে। তাকে কি কয়েকদিনের মধ্যেই একজন বিচারক টেনে হিঁচড়ে ফাঁসির ঝুপ কাষ্ঠের কুপের উপরে ঝুলিয়ে দিতে পারবেন? বিচারকের ইচ্ছে থাকলেও সে উপায় নেই। ফেনীর হতভাগ্য নুসরাতের এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের পরে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে রায় ঘোষণা পর্যন্ত যতগুলো ধাপ, যতগুলো কার্যপ্রণালী ফলো করতে হবে, এর পেছনে যতটা সময় ব্যয় হবে, তত দিনে একটা দেশের ইতিহাসও বদলে যেতে পারে। কারণ মামলা একটা না। এমন হাজার হাজার মামলা প্রতি নিয়ত কোর্টে উঠছে, নামছে, ডেট পড়ছে। শুধু বিশেষ দুই একটা মামলার দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ কোথায়। বিচারক দশ-বিশ বছর আগের মামলার রায় লেখবেন, না দুইদিন আগের সদ্য এক হত্যাকান্ডের বিচার করবেন, ভাবনার বিষয়!
এই যে নুসরাতের হত্যাকান্ডের বিচার- এর জন্য থানায় মামলা হয়েছে। এখন তদন্ত চলছে। অনেক আসামি পলাতক। কেউ কেউ হাজতে। হাজতিদের রিমান্ড, প্রয়োজনে আবার রিমান্ড, আলামত উদ্ধার, পলাতকদেরকে পাকড়াও সহ সাক্ষীদের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি। আসামিরা স্বীকারোক্তি দিতে চাইলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি, এদিকে নিহত নুসরাতের ডাইয়িং ডিক্লেয়ারেশন নথিবদ্ধ করতে হবে। তার অন্যান্য অডিও ভিডিও সংরক্ষণ ও নথিবদ্ধ করণ, কোন নোট থাকলে তারও সংরক্ষণ সহ যাবতীয় কাজ আঞ্জামের মধ্যেই চলতে থাকবে ধৃত আসামিদের বার বার আইনগত জামিন শুনানি নামঞ্জুরের হিড়িক- এসবের আদেশও নথিবদ্ধ করতে হবে। এর মাঝে তদন্ত টিমের উপর আস্থা অনাস্থার ব্যাপার থাকে, তদন্ত রিপোর্টের গ্রহণ বা নারাজি শুনানি, আবার তদন্তে দেওয়া, এরপর না হলে আবারও অন্য তদন্ত টীমকে দিয়ে তদন্ত করানো সহ নানাবিধ কাজের আঞ্জাম দিতে হয়, তদারকি করতে হয়, আদেশ দিতে হয় আদালতকেই। এ তো গেল শুধু তদন্ত স্টেজের কথা। কোন আসামি পলাতক হলে তার জন্য পএন্ডএ ইস্যু করতে হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়। এর পর সব অভিযুক্ত হাজির হলে বা ধৃত হলে আমলি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত থেকে গুরুত্ব বা অপরাধের অভিযোগ বিবেচনায় মামলাটি নির্ধারিত আদালতে বা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিজের আদালতেই বিচারের জন্য তারিখ ফেলেন।
বিচারের জন্য মামলার ফাইল প্রস্তুত করতে এছাড়াও আরো অনেক গলদঘর্মের ব্যাপার আছে। আছে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের এড ইন্টারিম আদেশ পালনের ব্যাপার, ৪৯৮ ধারায় জামিনের ব্যতিব্যস্ততা, জেলা আদালতের রিভিশন, মিসকেসের ঝামেলা।
এভাবে লক্ষ লক্ষ মামলা সমান প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায় সমান গতিতে। থমকে না গেলেও জ্যামিতিক হারে মামলার প্রবৃদ্ধির কারণে আদালতে প্রায় অর্ধকোটি মামলার জ্যাম তো থাকছেই।
তারপরও আদালতে কাজ চলতে থাকে। সারাদিন কাজ সেরে আপাদমস্তক ঘর্মাক্তকলেবরে, কাকভেজা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যখন পত্রিকা বা ফেসবুকে মানুষের হাহাকার, আদালত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য, জনকণ্ঠে অগ্নিবীণার সুরের অনুরণন শুনি তখন বিচারক হিসাবে মন খারাপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। এটা সত্য যে লক্ষ লক্ষ মামলার বিপরীতে আমাদের বিচারক স্বল্পতা, অবকাঠামোর অপ্রতুলতা সহ আরো নানাবিধ মামলার কাজের চাপে মুষ্টিমেয়র আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, তবুও সাধারণজন হয়ত জানেন না কতগুলো ধাপ, কতগুলো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটা দায়েরকৃত মামলাকে বিচারের জন্য প্রস্তুত করতে হয়।
এবার আসুন বিচারের দিকে। বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর আবার শুরু হয় সাক্ষী হাজির করার জন্য টানাটানি। আজকে যে লোকেরা স্লোগান তুলে গলা ফাটাচ্ছেন এদেরকেই এক সময় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে পাওয়া যাবে না। দিনের পর দিন মাসের পর মাস আদালতের সমন ওয়ারেন্ট নিয়ে এদের পেছনে পুলিশকে ঘুরতে হবে। আবার একজন আসলে পরের জনের খবর থাকবে না। কেউ কেউ চলে যাবেন বিদেশে। এমনই হয়ে আসছে বরাবর। আবার তাদের জন্য অপেক্ষা। কারণ আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ রেকর্ড না করে রায় দিতে পারেন না৷ সে বিধান নাই। অডি অলটারেম পার্টেম নীতিও মানতে হয়। অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত উভয় পক্ষের কথাই শুনতে হয়।
বিচারককে খেয়াল রাখতে হয় বিঅন্ড রিজনেবল ডাউটের দিকে। সামান্যতম খাদ থাকলে তা যাবে অভিযুক্তের পক্ষেই। এখানে আদালতের বা বিচারকের করার কিছু নাই। প্রসিকিউশন টীমের দায়িত্ব মামলাকে প্রমাণ করা, বিচারকের না। বিচারক উভয় পক্ষের কথা সমান গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন এটাই নিয়ম। এসবের ব্যতিক্রম হলে বিচারকে অতিক্রম করে অবিচার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এত কিছুর পরে একটা রায় বের হওয়ার পর আছে সুপ্রিম কোর্টে কনফার্মেশন, আপিল, রিভিশন রিভিউ সহ আরো নানা কাজ।
এত কথা, এত অভিযোগ, এত আপত্তির পরও একজন বিচারক হিসাবে দেশের জনগণের অভিপ্রায়, আবেগ ও ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে আমিও চাই এবং আদালতও চায় দ্রুত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার উপহার দিতে। বিচারক এবং আদালতও চায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বা এ ধরনের নানা অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসতে কিন্তু সে জন্য যথেষ্ট জনবল, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ, অবকাঠামোগত সমস্যার নিরসন দরকার খুবই জরুরি ভিত্তিতে, অতীব জরুরিভিত্তিতে।
ফৌজদারি কার্যবিধির সেকেলেপনার কারণেও মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা- চলে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। সময় এসেছে ১৮৯৮ সালের আইনেরও আমূল পরিবর্তনের।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।