মোহাম্মদ রিদোয়ানুল ইসলাম :
আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছেন। উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও অবকাঠামোর দিকবিবেচনায় যেসব প্রকল্পগুলো (চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক) সরকার হাতে নিয়েছেন এবং নিতে যাচ্ছেন তা যে কোন বিবেচনাতেই অভূতপূর্ব। মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোন অনুমোদনকৃত ৮৮টি ইকোনমিক জোন (প্রস্তাবিত ১০০), বঙ্গবন্ধু টানেল, বে-টার্মিনাল, সিটি আউটাররিং রোড, কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প, হালদা নদীতে বেড়ীবাঁধ, ১ম মেরিটাইম বিশ্ব বিদ্যালয়সহ চট্টগ্রামে এক ডজনেরও বেশী হাই- প্রোফাইল প্রকল্প চলমান।
এসব কর্মযজ্ঞের কথা যখন আসে তখন অবধারিতভাবেই সামনে আসে প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি। সিভিল আপীলনং ৪৮/২০১১ তে মাননীয় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে সামরিক আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করায় ও সংবিধান (সপ্তম সংশোধন) আইন ১৯৮৬ বাতিল ঘোষিত হওয়ায় ১৯৮২ সালের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল সংক্রান্ত আইনটি বাতিল হয়ে যায় ও সরকার স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ নামে নতুন আইন প্রণয়ন করেন। এ আইনের ৪ ধারায় প্রাথমিক নোটিশ জারী (প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণ এলাকায়) এবং ঐ নোটিশ জারীর পরে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি যৌথ তালিকা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। ৫ ধারায় বলাআছে, প্রাথমিক নোটিশ জারীর ১৫ দিনের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের নিকট আপত্তি দাখিল করতে পারবেন। আপত্তি পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক উক্ত বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের জন্য পাঠাবেন। এছাড়া অত্র আইনের ৭ ধারায় অধিগ্রহণ সংক্রান্ত চূড়ান্ত নোটিশ ও ৯ ধারায় ক্ষতিপূরণ বিষয়ে যাবতীয় বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হিসেবে বলা হয়েছে অধিগ্রহণকারী যদি সরকার বা সরকারী সংস্থা হয় তাহলে বাজার দরের উপর অতিরিক্ত শতকরা ২০০ ভাগ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। অর্থাৎ জমির মূল্য ১ লাখ টাকা হলে এক্ষেত্রে ১ লাখ টাকাসহ আরো অতিরিক্ত ২ লাখ মোট ৩ লাখ টাকা পাওয়ার বিধান করা হয়েছে। আর ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে উক্ত আইনের ৮ ও ১১ ধারায়, ৮ ধারায় একটা রোয়েদাদের তালিকা তৈরী পূর্বক, ১১ ধারায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড়ের বিষয়ে বলা হয়েছে।
তাছাড়া অত্র আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- ক্ষতিপূরণ সংক্রান্তে কোন ধরণের মতবিরোধ দেখা দিলে উক্ত বিষয়টা নিয়ে আরবিট্রেশনে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ৮ ধারায় (৪) উপ-ধারায় এটাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রাক্কলিত ক্ষতিপূরণ রোয়েদাদ, সরকারী সংস্থা (যারা অধিগ্রহণ করবে) কর্তৃক ১২০ কার্য দিবসের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিতে হবে। এরূপের ব্যত্যয় ঘটলে ১৪ ধারায় অধিগ্রহণ বাতিল ঘোষণা করতে পারেন জেলা প্রশাসক। অর্থাৎ সমস্ত দিক বিবেচনা করলে এ আইনটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যেতে পারে। কারণ অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ও ক্ষতিপূরণ সমস্ত কিছুই এই আইনের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে সরকারের উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি এ আইনের অপপ্রয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহুবার জনমনে ক্ষোভ দানা বাধতে দেখা গিয়েছে। কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্পে অনেক ভুক্তভোগী ক্ষতির্পূরণের ন্যায্য টাকা না পাওয়ার কথা পত্রিকার বরাতেই আমরা জেনেছি। আউটাররিং রোড প্রকল্পের কাজও অনেকদিন বন্ধ ছিল কারণ ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশীরা প্রচলিত উপায়ে ক্ষতিপূরণ না পেয়ে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দায়ের করেছিলেন বলে, এমনকি ক্ষতিপূরণ ছাড় করণ সংক্রান্ত বিষয়ে জেলা প্রশাসকের এল.এ শাখায় বিভিন্ন দালাল গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেও দেখা গেছে। ক্ষতিপূরণ ছাড় করাতে গিয়ে ঘুষ বাণিজ্য তো আছেই।
উন্নয়ন কর্মকান্ড সবসময়ই প্রশংসিত। আর বাণিজ্যিক নগরীতে যে সব উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে, তা অদূর ভবিষ্যতে এ এলাকার অর্থনৈতিক চেহারাই পাল্টে দিবে। চট্টগ্রামকে এদেশের লাইফলাইন বলা হয়। একটি বে-টার্মিনাল বা সর্ববৃহৎ ইকোনমিক জোন বা কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল এ অঞ্চলকে সত্যিই তিলোত্তমা করে তুলবে। তবে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রমকে স্বচ্ছতায় ও জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। মনে রাখা উচিত, এ সমস্ত উন্নয়নের আল্টিমেট সুফলভোগী দিনশেষে ঐ জনগণই। তাই যে কোন মূল্যে মানুষের ন্যায্যটা নিশ্চিত করা উচিত।
লেখক : অ্যাডভোকেট, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট