মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান:
বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি ক্রমাগতভাবে যৌন নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। নিজ কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পর্যায়ের যৌন নিপিড়নের শিকার হতে হচ্ছে। কখনও কখনও তা প্রকাশিত হয়, কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন, আবার কখনো কখনো তা গোপন রয়ে যায় কিংবা ভিকটিম নিরবে সহ্য করে যায়। দেশের অসংখ্য ঘটনার মাঝে আলোচিত কয়েকটি ঘটনায় চোখ বুলালেই দেখা যায়- ২০০১ সালে যৌন হয়রানির কারণে নারায়ণগঞ্জে চারুকলার ছাত্রী সিমি বানুর আত্মহত্যা, ২০০২ সালে ধর্ষিত মহিমা খাতুনের আত্মহত্যা, ২০০৩-এ ধর্ষিত হয়ে গার্মেন্টসের কর্মী শাহীনুরের ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা, অপহরণের পর এক সপ্তাহ ধরে ধর্ষিত হওয়ায় কলেজছাত্রী বিভা রানী সিংহ ও নিজ মায়ের সামনে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ায় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী আলপিনার আত্মহত্যা এবং ২০০৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে নয় বছর বয়সী চামেলী ত্রিপুরার ধর্ষণ। ২০১৬ সালে কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনুর নির্মম পরিণতি, ২০১৭ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে আইন বিভাগের ছাত্রী রূপা খাতুনকে ধর্ষণের পর হত্যা। ২০১৯ সালে এসে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ কর্তৃক যৌন নিপিড়ন পরবর্তীতে আগুনে পুড়িয়ে হ্ত্যা। অসংখ্য ঘটনার মাঝে এগুলো সামান্য কিছু উদাহরণ মাত্র।
দেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দিষ্ট কোন আইন না থাকায়, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি’র (BNWLA) দায়ের করা এক রিট পিটিশনের (PIL) পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে কয়েকটি দিকনির্দেশনা উল্লেখ করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছেন।
পাশাপাশি উক্ত নীতিমালার ৪ ধারায় যৌন নিপীড়নকে সংজ্ঞায়িত করে আদালত বলেন, শারীরিক ও মানসিক যে কোনো ধরনের নির্যাতন যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। ই-মেইল, মুঠোবার্তা (এসএমএস), পর্নোগ্রাফি, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, যে কোনো ধরনের চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। আর যেহেতু শুধু কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে না, তাই রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের অশালীন উক্তি, কটূক্তি করা কিংবা কারও দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো ইত্যাদি যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য হবে। এই রায় অনুযায়ী, কোনো নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা, দেয়াললিখন, অশালীন চিত্র ও আপত্তিকর কোনো ধরনের কিছু করা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে।
উক্ত রায়ে বলা হয়, দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে অভিযোগ কমিটি থাকবে।উক্ত কমিটি যৌন হয়রানির কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে পুলিশের কাছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠাবেন। এরপর দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধের ধরন ও মাত্রা বুঝে বিচার বিভাগীয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, কমিটি নির্যাতন সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং পুলিশের কাছে অপরাধীকে না পাঠানো পর্যন্ত নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না।
২০০৯ সালের উক্ত রায়ে সংসদের আইন প্রণয়ন করতে বলা হলেও সরকারের এখনও তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। যদিও আইন কমিশন ২০১০ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ২০১০ নামে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া তৈরী করলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
অন্যদিকে, যৌন হয়রানি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোন আইন না থাকলেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১০ ধারায় বলা হয়- যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যুন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷এ সংক্রান্ত বিষয়ে দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৫৪ ধারা এবং ৫০৯ ধারায় যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে তাও অত্যন্ত নগন্য শাস্তি বলে আমার মনে হয়।
তাই যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইনের অভাবে যে আইনগত শূন্যতা (Legislative vacuum) তৈরী হয়েছে তা কিছুটা নিরসন করেছে বাংলাদেশ সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ। উক্ত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত প্রদত্ত নীতিমালা সুনির্দিষ্ট আইন প্রনীত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যকরী। তবে দেশের ক্রমবর্ধমান সমস্যা মোকাবিলায় কঠোর শাস্তির বিধান রেখে যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন প্রনয়ন এখন সময়ের দাবী। তাই সবগুলো অপরাধের ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণসহ দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নতুন আইন প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরী। পাশাপাশি যৌন হয়রানি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী করা, যৌন অপরাধের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে এবং এটি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যকর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ ও প্রক্টর, ফেনী ইউনিভার্সিটি