নাশকতা, চাঁদাবাজি ও মানহানির বিভিন্ন মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েক নেতাকে হাইকোর্টের দেয়া আগাম জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে এ বিষয়ে পরবর্তীতে লিখিত আদেশ দেবেন বলেও জানিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
এই আদেশের ফলে হাইকোর্ট বিএনপি নেতাদের যে আগাম জামিন দিয়েছেন তা নাকচ হয়নি এবং তাদের আগাম জামিন বহাল রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান- জামিন বহাল রয়েছে কিনা রায়ের কপি না দেখে বলা যাবে না।
এ মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া অন্যান্য নেতারা হলেন, সংগঠনের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, দলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন ও বরকত উল্লাহ বুলু, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ, ড্যাব নেতা এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
এছাড়া একই মামলায় আসামি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ।
তাদের জামিন স্থগিতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কিছু পর্যবেক্ষণসহ (অবজারভেশন) নিষ্পত্তি করে আদেশ দেন।
আদালতে বিএনপি নেতাদের পক্ষে শুনানি করে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মাসুদ রানা। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির।
আপিল বিভাগের আদেশের পর খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের আদেশে বিএনপি নেতাদের আগাম জামিনের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের আপিল নাকচ করে আদালত আবেদন নিষ্পত্তি করেছেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেন, আগাম জামিনের ব্যাপারে এ আপিল বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। যে সিদ্ধান্ত রয়েছে তা পরিবর্তন চেয়ে আমরা একটি নীতি নির্ধারণ করে দিতে বলেছি। আমরা পরিবর্তন চেয়ে একটি পলিসি নির্ধারণ করে দিতে বলেছি। কারণ সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তাতে হাইকোর্টের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। হাইকোর্টের ক্ষমতা খর্ব না করে জনস্বার্থে ওই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হওয়া দরকার। এ বিষয়ে আপিল বিভাগের একটি গাইডলাইন প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আগের গাইডলাইনের কারণে আগাম জামিন সীমিত হয়ে গেছে। আপিল বিভাগের লিখিত আদেশ পেলে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কি না তা বোঝা যাবে। ৬৬ ডিএলআর এর যে সিদ্ধান্ত চার সপ্তাহের বেশি জামিন দেয়া যাবে না। সেখানে উক্ত আসামিদের চার সপ্তাহের বেশি জামিন দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, তখন নির্বাচনকালীন সময় অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঢালাওভাবে পুলিশ মামলা দেয়। এতে মৃত ব্যক্তি বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়। সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চার সপ্তাহের বেশি জামিন দিতে পারেন। ৬৬ ডিএলআরের এই সিদ্ধান্ত ৫১ ডিএলআরের ওয়াহাব শাহের মামলার পরিপন্থী।
গত অক্টোবর মাসে রাজধানীর হাতিরঝিল ও খিলগাঁও থানায় করা নাশকতার দুই মামলায় হাইকোর্টে জামিন পান বিএনপি নেতারা।
এর আগে গত ১ অক্টোবর হাতিরঝিল থানায় সরকারবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৫৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করে পুলিশ।
মামলায় পুলিশ বলছে, বিএনপি কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে। সেখানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।
আরো বলা হয়, বিএনপির এসব নেতার এমন বক্তব্যের পর ১ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে হাতিরঝিল থানার মগবাজার রেলগেট এলাকায় বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল এবং জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ৭০ থেকে ৮০ জন নেতাকর্মী জড়ো হন। তারা রাস্তায় যান চলাচলে বাধা দেন। পুলিশ জড়ো হওয়া নেতাকর্মীদের সড়ক অবরোধ না করতে অনুরোধ করে। কিন্তু পুলিশের অনুরোধ উপেক্ষা করে তারা পুলিশকেই হত্যার উদ্দেশ্যে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। সেখানে দু’টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং একটি বাস ভাঙচুর করা হয়। প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তারা লাঠি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মারধর শুরু করেন এবং ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান।
মামলায় আরো বলা হয়, ভাঙচুর করা গাড়িগুলো আত্মরক্ষার্থে দ্রুত চলে যাওয়ায় গাড়ির নম্বর সংগ্রহ করতে পারেনি পুলিশ।
এরপর হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে আগাম জামিন প্রার্থনা করলে সংশ্লিষ্ট মামলায় পুলিশ প্রতিবেদন জমা না দেয়া পর্যন্ত তাদের আগাম জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন আদালত। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ ও বিচারপতি কাশেফা হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এরপর ওই আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। যা আজ নিষ্পত্তি করা হয়।