মোঃ নাজমুল হোছাইন:
ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক খাদ্যে ভেজাল রোধে জরিমানা আরোপ কিংবা দুই/তিন মাসের সাজা দেওয়াটাকে বড় ভাই কর্তৃক ছোট ভাইকে তার বড় বড় অপরাধের বড় শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য দুই/চারটা চড় থাপ্পর আর বকাবকি করার মতো মনে হয়।
ব্যবসায়ীদের ফিলোসপি হচ্ছে তারা কখনো লস করবে না। কাজেই আপনি তাদের যতই জরিমানা আরোপ করেননা কেন তার ভার আলটিমেটলি ভোক্তার উপরেই বর্তায়।
ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রচুর কাজ করছেন বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্টমিডিয়া মারফত জেনেছি। এখন কথা হচ্ছে অপরাধের শাস্তিটা অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে কিনা? ধরুন আপনার খুব কাছের একজনকে খুন করা হয়েছে। আর আইন অনুযায়ী সেই খুনির শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কিন্তু তাকে যদি কিছু টাকা জরিমানা আর মাস পাঁচেক কারাদন্ড দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তাইলে আপনার ফিলিংসটা কেমন হবে? অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি হয়েছে কিনা?
খাদ্যে ভেজাল দেওয়াটাকে গণহত্যার সাথে তুলনা করাটা নিতান্তই অমুলক হবেনা। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিনকে দায়ী করে। টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশের পর এমন কোনো অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করেনা। তবে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হৃৎপিন্ড ও অস্থিমজ্জার। ধীরে ধীরে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের বেলায় নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি, তরুণদের কিছুটা দেরিতে। বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং ৯১ হাজার ৩৩৯ জন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন। ক্যান্সার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবক্যানের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১৩ থেকে ১৫ লাখ। এবার আপনি আপনার আশেপাশে কতজন ক্যান্সার রোগী আছে এবং তাদের সিম্পটমগুলো মিলিয়ে নিন। আর ক্যান্সারের শেষ পরিণতি মৃত্যু সাথে একটা পরিবারকে আর্থিকভাবে নিঃস করে দেয়া। এবার আপনিও আমার সাথে একমত হতে দ্বিধা করবেননা যে খাদ্যে ভেজাল গণহত্যারই সামিল।
এখন প্রশ্ন হলো খাদ্যে ভেজালের শাস্তি কি তাহলে?
খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে দেশের প্রচলিত আইনেই। অথচ অজ্ঞাত কারণে ওই আইনটি প্রয়োগ করা হচ্ছেনা। খাদ্যে ভেজালকারীদের আইনে নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির এদেশে নেই। অথচ উন্নত বিশ্বে বা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ওইসব দেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর হার কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধের শাস্তি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাবজ্জীবন, চীনে মৃত্যুদণ্ড, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। এসব দেশে বর্তমানে এসব কঠোর আইনেই ভেজাল মেশানোর অপরাধের বিচার হচ্ছে।
আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। এ আইনের ২৫(গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করলে অপরাধী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে বলে বিধান করা হয়। এছাড়া ক্ষতিকর প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন (যা মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর) করলে অপরাধীকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বা যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান করা হয়। কিন্তু এমন আইন প্রয়োগের বা এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত এ দেশে নেই।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এ পণ্যের মোড়ক বিধি অমান্য করা; পণ্যের মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করা; ধার্য্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয়; ভেজাল পণ্য বা ঔষধ বিক্রয়; খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ; জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ; মিথ্যা বিজ্ঞাপণ দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা; প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা; বাটখারা, ওজন বা দৈর্ঘ্য পরিমাপক পরিমাপে কারচুপি; পণ্যের নকল উৎপাদন; মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয়; সেবা গ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য, জীবন হানি ঘটানো বা নিরাপত্তা বিপন্ন করা এই অপরাধসমূহের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর কারাদন্ড বা ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড দেওয়ার বিধান করা হয়। এ আইনে মামলা করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মচারীদের উপর। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা মামলা ও তারা করেনি। বরং তাদের দপ্তরে একটা অভিযোগ নিয়ে নিজেরাই কিছু জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। ফলে আইনের উদ্দেশ্য বইয়ের পাতায়ই রয়ে যায়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৬৬ ধারা অনুযায়ী একজন ভোক্তা সরাসরি দেওয়ানী আদালতের সরণাপন্ন হতে পারবেন। এই ধারায় বলা হয়েছে, কোন বিক্রেতার ভোক্তা–অধিকার বিরোধী কার্যের দ্বারা কোন ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে এবং উক্ত ক্ষতির পরিমাণ আর্থিক মূল্যে নিরূপণযোগ্য হলে, উক্ত নিরূপিত অর্থের অনূর্ধ্ব পাঁচগুণ পরিমাণ আর্থিকক্ষতি পূরণ দাবী করে উপযুক্ত আদালতে দেওয়ানী মামলা দায়ের করা যাবে।
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর অধীনে সারা দেশে খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই আইনের ৬৬ ধারায় ফুড ইন্সপেক্টরকে খাদ্য আদালতে মামলা দায়েরের ক্ষমতা প্রদান করা হলেও কালেভদ্রেও তাদেরকে আদালত প্রাঙ্গণে দেখা যায়না। তবে তাদেরকে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক বাজারে পরিচালিত অভিযানের ক্যান্ডিড ছবি বা ভিডিও তে দেখা যায়। আজকাল সবকিছুই যেন প্রচার সর্বস্ব হয়ে গেছে।
অনেক আইন হবে, আইনের প্রয়োগের রমরমা প্রচার হবে। কিন্তু ততদিনে আপনার/আমার শরীরে বাসা বাঁধবে মরণব্যাধি ক্যান্সার। আজকে আপনার গলায় একটা গুটি দেখা দিলো কাল ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারলেন ক্যান্সার আপনার গলা বেয়ে লিভার অবধি গড়িয়েছে। সরকার আইন প্রণয়ন করছে আপনার প্রটেকশনের জন্য, আপনাকেই আইনের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। অমুকের ক্যান্সার হয়েছে আমারতো হয়নি এই ধ্যানধারণাই বসে না থেকে আপনার ক্যান্সার হওয়ার আগেই খাদ্য সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত আইনের আওতায় নিয়ে আসুন। সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
লেখক- সহকারি জজ, সুনামগঞ্জ।