মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি। এই চুক্তি সম্পাদনের অন্যতম উপাদান হলো দেনমোহর। অনেকে দেনমোহরকে মোহর বা মোহরানাও বলে। এর ইংরেজি রূপ Dower হলেও দেনমোহর কোন যৌতুক নয়। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট প্রিয়াংকা মজুমদার।
দেনমোহর কি:
দেনমোহর হল কোন অর্থ বা সম্পত্তি যা স্ত্রী বিয়ের প্রতিদান হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে পাওয়ার অধিকারী হয়। এটা বিয়ের আগে বা পরে বা বিয়ের দিনও নির্ধারণ করা যায়। দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি নিদর্শন। স্ত্রীর অধিকার রক্ষার জন্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য দেনমোহর দেয়াহয়৷ ইসলামিক আইনে দেনমোহরের মালিক শুধুমাত্র স্ত্রী হয়। একজন স্ত্রী ইচ্ছা করলে দেনমোহর এর কোন অংশ কিংবা সমস্ত দেনমোহর মাফ করে দিতে পারেন। তবে শর্ত থাকে যে সেটি যেন বিনা প্ররোচনায়, সরল মনে ও সুস্থ শরীরে হয়।
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি লর্ড পারকার বলেন, “দেনমোহর হল একজন স্বামীর উপর ন্যাস্ত তার স্ত্রীর প্রতি একটি আবশ্যিক দায়িত্ব বিশেষ”।
দেনমোহর বা মোহরানা নির্ধারণ না করে বিয়ে হলে শুধুমাত্র এই কারনে সেই বিয়ে বাতিল হবে না। অর্থাৎ দেনমোহর ছাড়া বিয়ে বৈধ তবে বিয়ের পর যেকোনো সময় বা স্ত্রী চাহিবা মাত্র এটি পরিশোধ করতে হবে। ইসলামিক আইন অনুযায়ী স্ত্রী দেনমোহর দাবী করবে না এই শর্তে কোন বিয়ে হলেও স্ত্রী যথাযথ এবং উপযুক্ত দেনমোহর পাওয়ার হকদার। স্বামীর মৃত্যুর পরেও তার সম্পত্তির উপর দেনমোহরের অধিকার প্রয়োগ করা যাবে। অর্থাৎ দেনমোহর এড়িয়ে যাওয়ার আইনগত কোন সুযোগ নেই, এটি দিতেই হবে।
দেনমোহর দুই প্রকার। তাৎক্ষণিক দেনমোহর যা চাহিবা মাত্র দিতে হবে। এটি না পাওয়া পর্যন্ত স্ত্রী স্বামীর সাথে বসবাস করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। অপরটি হচ্ছে বিলম্বিত দেনমোহর।
ক) বিবাহবিচ্ছেদ,
খ) স্বামীর মৃত্যুর পর বা
গ) স্বামী সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া একাধিক বিয়ে করলে,
বিলম্বিত দেনমোহর আদায়যোগ্য হবে। বিয়ের সময় যদি দেনমোহরের কিছুটা তাৎক্ষণিক হিসেবে দেয়া হয় সেটা কাবিননামায় উল্লেখ করা হয় উসুল হিসেবে বাকিটা বিলম্বিত দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে।
স্ত্রীর জন্য দেনমোহর অধিকার:
দেনমোহর মূলত স্ত্রীর অধিকার সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়। মোহরানার পরিমাণ যাই হোক না কেন তা অবশ্যই আদায়যোগ্য। স্বামী দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করে আদায় করতে পারবেন। দেনমোহর দাবী করার পরে স্বামী ওই দাবী পরিশোধ না করলে স্ত্রী আলাদা বসবাস করতে পারবেন এবং স্বামী ওই সময়ে ভরণ পোষণ দিতে বাধ্য। প্রত্যেক নারীর কাবিননামার ১৩-১৬ নং কলাম সম্পর্কে এবং মোহরানার বিষয়টি যেন সুনির্দিষ্ট থাকে সে ব্যাপারে অবগত থাকা উচিত। অনেক সময় বিয়ের গয়না, শাড়ী, দামী জিনিস ইত্যাদির মূল্য কাবিনে উল্লেখিত দেনমোহরের একটি অংশ ধরে উসুল লিখে দেয়া হয়। পরবর্তীতে যদি দেনমোহর আদায়ের প্রশ্ন আসে তখন কিন্তু উসুল লিখে দেয়ার কারনে দেনমোহর পাবেনা। আদতে বিয়েতে দেয়া উপহার দেনমোহর নয়। এটাকে উসুলও বলা যাবে না। আবার স্বামী যদি স্ত্রীকে উপহার হিসেবে একখন্ড জমি বা ফ্ল্যাট লিখে দেন সেটিও দেনমোহর হবেনা। দেয়ার সময় উল্লেখ করা হলে তখন সেটি দেনমোহর হিসেবে গণ্য হবে নচেৎ উপহার কখনো দেনমোহর হতে পারে না।
স্বামীর জন্য দেনমোহর ঋণ:
দেনমোহর স্বামীর জন্য একটি ঋণ। অনেক স্বামী মনে করেন আমিতো স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিচ্ছিই আবার আলাদা করে মোহরানা দিতে হবে কেন। মনে রাখতে হবে মোহরানার সাথে ভরণপোষণের কোন সম্পর্ক নেই। এ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা অধিকার যা স্বামীকে প্রদান করতে হয়। স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ হোক বা না হোক দেনমোহর দিতে হবে। যদি স্বামীর আগে স্ত্রী মারা যায় তবুও দেনমোহর দিতে হবে। স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা সেটি আদায় করতে পারবে। “মোজাহেদুল ইসলাম বনাম রওশন আরা (২২ ডি.এল.আর ৬৭৭ পৃষ্ঠা)” মামলায় বলা হয়েছে, দেনমোহর কখনো মাফ হয় না। স্বামী যদি মারাও যায় তার সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যাবে। স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও আদালত স্বামীকে দেনমোহরের দায় থেকে মুক্তি দিবে না। মোহরানা একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে আর কমানো যায়না তবে স্বামী ইচ্ছা করলে এর পরিমাণ বাড়াতে পারেন।
৩) দেনমোহরে কি দিবে:
ইসলামিক আইনের নীতি বিরোধী নয় মূল্য আছে, অস্থিত্ব আছে এবং প্রচলিত আইনে অবৈধ নয় এমন অর্থ বা সম্পত্তি মোহরানা বা দেনমোহরের বিষয় হতে পারে। অনেকে মনে করেন যে দেনমোহর এক প্রকার পণ। মূলতঃ দেনমোহর হল স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি প্রতীক।
আইন যা বলে:
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ১০ ধারা অনুযায়ী, “where no details the mode of payment of dower are specified in the nikahnama, or the marriage contract, the entire amount of the dower shall be prescribed to be payable on demand”.
কোন বিবাহে দেনমোহরের কথা না থাকলেও আইন স্ত্রীকে দেনমোহরের অধিকার দেয়। বিবাহের সময় এটি নির্ধারিত না থাকলেও আইনতঃ পরবর্তীকালে নির্ধারণের ব্যবস্থা রয়েছে।
দেনমোহর সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও সাধারণ জিজ্ঞাসা:
দেনমোহর সংক্রান্ত যে প্রশ্নগুলো সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হলো-
১) দেনমোহরের পরিমাণ কতটুকু হবে: স্বামীর আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেনমোহর নির্ধারিত হবে। দেনমোহরের কোন সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নেই তবে হানাফী মতে দেনমোহরের নির্ধারিত পরিমাণ, ১০ দিরহামের কম হবেনা আবার মালেকী মত অনুযায়ী দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ ৩ দিরহামের কম হওয়া যাবেনা। দেনমোহরের পরিমাণ কম না বেশি হবে সেই ব্যাপারে কোন আইনগত বিধি নিষেধ নেই তবে এর পরিমাণ এত বেশি নির্ধারণ করা উচিত নয় যা স্বামীর পক্ষে দেয়া অসম্ভব।
২) কখন দেনমোহর দাবী করা যাবে: একজন স্ত্রী যেকোন সময় তার স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহর দাবী করতে পারেন।
৩) বিয়ের উপহার দেনমোহর কি-না: দেনমোহর স্ত্রীকে স্বামীর দেয়া মূল্যবান অর্থ বা সম্পদকে বোঝায়। বিয়ের উপহার যেমন দামী শাড়ি, গয়না ইত্যাদি কখনোই দেনমোহর হিসেবে বিবেচিত হবেনা।
৪) স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দেয় দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে কি-না: দেনমোহর হল মুসলিম বিবাহের একটি শর্ত যার সাথে তালাকের কোন সম্পর্ক নেই। স্বামী স্ত্রী যেই আগে তালাক দিন না কেন দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে নতুবা এটি ঋণ হিসেবে থেকে যাবে।
৫) ভরণপোষণ ও দেনমোহর দুটোই দিতে হয় কি-না: স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তালাক হলে সেটা কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত স্বামীকে ভরণ পোষণ দিতে হয়। ভরণপোষণের সাথে মোহরানার কোন সম্পর্ক নাই। তাই মোহরানা বা দেনমোহর সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হবে।
৬) স্বামীর মৃত্যুর পর দেনমোহর আদায় করা যাবে কি-না: স্ত্রীর মোহরানা স্বামীর উপর একটি ঋণস্বরূপ। মোহরানা পরিশোধ না করে স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রী স্বামীর বিষয় সম্পত্তি দখলে রাখতে পারে এবং সেখান থেকে মোহরানা আদায় করতে পারে। তবে প্রাপ্য মোহরানা আদায় হয়ে গেলে উক্ত সম্পত্তি স্ত্রী দখলে রাখতে পারবে না। দেনমোহরের দাবীতে কোন বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি দখল করে থাকলে যদি তাকে অন্যায়ভাবে সেই সম্পত্তি হতে বেদখল করা হয়, তবে সে দখল পূণরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। (মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব (১৯১৬) পৃষ্ঠা-৩৪)।
৭) স্ত্রী মোহরানা না পেলে কি করবে: পারিবারিক আদালতে মামলা করে এটি আদায় করতে পারে।
৮) স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হলে কি হবে: যদি স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় তবুও স্ত্রীর দেনমোহর স্বামীকে প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর উত্তরাধিকারী এই মোহরানা পাওয়ার অধিকারী হবে।
৯) দেনমোহর কখন অর্ধেক হবে: বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য মিলন কিংবা সহবাসের পূর্বে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করতে হবে।
১০) স্বামীর মৃত্যুর পর মোহরানা আদায় না করে স্ত্রীরও মৃত্যু হলে কি হবে: স্বামীর মৃত্যুর পর মোহরানা আদায় না করে স্ত্রীরও মৃত্যু হলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা মোহরানা পাওয়ার অধিকারী হবে।
প্রতিকার: দেনমোহর আদায়ের জন্য মোহরানা দাবি বা সেটি দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ৩ বছরের মধ্যে স্থানীয় সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করা যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে দেনমোহর সংক্রান্ত সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত কথাটি হল, “স্ত্রী তালাক দিলে কেন দেনমোহর দিতে হবে”। সত্যিকার অর্থে তালাকের সাথে দেনমোহরের কোন সম্পর্ক নেই। দেনমোহর প্রদান না করলে স্বামী সারাজীবন স্ত্রীর কাছে ঋণী থাকবেন। কেউ নিশ্চয়ই সেটি চাইবেন না। আজকাল সামজিক স্ট্যাটাস মেইনটেইন করার জন্য অধিক মাত্রার মোহরানা ধার্য করা হয় যা অনুচিত। মোহরানা নির্ধারণে বর-কনে উভয় পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক হতে হবে।
চাহিবা মাত্র কিংবা বিবাহের পর যেকোন সময় একজন স্বামীর মোহরানা প্রদান করা উচিত। আর যতটুকু বা যখনই দেয়া হোক না কেন একজন নারীর উচিত মোহরানা বিষয়ক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
লেখক: আইনজীবী, ফেনী জজ কোর্ট।