সিরাজ প্রামাণিক:
দুই সন্তানের জননী সাথী (ছদ্মনাম)। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। স্বামী রিকশা চালায়, নেশা করে সাথীর উপর নির্যাতন চালায়। এতকিছুর পরও সাথী সংসার করতে চায়। তার ধারণা সংসার ভাঙলে সে কিছুই পাবে না। দুই সন্তানের বোঝা আর স্বামী স্বীকৃতির ভয় তাকে পেয়ে বসে। রিকশাচালক স্বামী একদিন রাতে সংসার করবেনা বলে জানিয়ে দেয় এবং দ্বিতীয় বিয়েতে আগ্রহ প্রকাশ করে। সাথীর মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে একজন আইনজীবীর কাছে। তিনি সবকিছু শুনে দেনমোহর আদায়, সন্তানের ভরণপোষণ ও অন্যান্য অধিকার বিষয়ে সাথীকে সচেতন করে। সাথী এবার মোহরানা, ভরণপোষণসহ তালাক চাওয়ার সাহস অর্জন করে। সাথীর স্বামীকে দেনমোহর প্রদানের প্রস্তাব দিলে সে বিষয়টিকে তাচ্ছিল্লের সঙ্গে উড়িয়ে দেয়। এরপর পারিবারিক আদালতে মামলা করে সাথীর সকল অধিকার আদায় করিয়ে দেয়া হয়।
দারুণ স্মার্ট আর শিক্ষিতা রুমানা (ছদ্মনাম) নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। ভালবেসে বিয়ে করে আরেক হ্যান্ডসাম, শিক্ষিত জামানকে। বিয়ের সময় জামানের দেয়া উপঢোকনকে দেনমোহর বলে মেনে নেয় রুমানা। কাবিননামার ১৪ নং কলামে মোহরানা পরিশোধ বলে বিয়ে সম্পন্ন হয়। দাম্পত্য জীবন অতিবাহিতকালে তাদের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। একপর্যায়ে সংসার ভেঙে যায়। বিয়ের উপঢোকনের বিনিময়ে রুমানার কাবিননামায় মোহরানার উল্লেখ না থাকায় সে মোহরানা থেকে সম্পূর্নভাবে বঞ্চিত হয়।
বিয়ের সময়ে দেয়া শাড়ী, গয়না ইত্যাদি কখনো দেনমোহরের অংশ হিসাবে বিবেচিত হবেনা। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে উসুল লিখে নেয়া হয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলোকে দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুল বলা যাবে না। (আঃ কাদের বনাম সালিমা, ১৮৮৬, ৮ অল. পৃষ্ঠা-১৪৯)।
সুজন ও ছন্দা একে অপরকে ভালবাসে। তাদের ভালবাসাকে বাস্তবে রুপায়িত করার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। সুজন এখনও বেকার। কাজী অফিসে গিয়ে একহাজার টাকা দেনমোহরে বিয়ে করে ছন্দা। ভালবাসার আবেগে নিজের অধিকারের কথা ভুলে গিয়ে নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনে ছন্দা। কিছুদিন যেতে না যেতেই ওদের দাম্পত্য জীবনে কলহ দেখা দেয়। দেনমোহর বাবদ একহাজার টাকা আর তিনমাসের খোরপোষ বাবদ নয় হাজার টাকা মোট দশ হাজার টাকা দিয়ে ছন্দাকে তালাক দিয়ে দেয় সুজন।
মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর শ্রদ্ধার নিদর্শন। যা পরিশোধে স্বামীর উপর দায় আরোপিতহয়েছে। দেনমোহর কত হবে তা নির্ণয়কালে স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে যেমন স্ত্রীর বোন, খালা, ফুফুদের ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ কত ছিল তা বিবেচনা করতে হয়। (হামিরা বিবি বনাম যুবাইদা বিবি, ১৯১৬, ৪৩ আই. এ. পৃষ্ঠা, ২৯৪)। তাছাড়া স্ত্রীর পিতার আর্থ-সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত যোগ্যতা, বংশ মর্যাদা, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। অপর দিকে বরের আর্থিক ক্ষমতার দিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়। এসব দিক বিচার বিবেচনা করেই মূলতঃ দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। উল্লেখ্য, দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না, তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন। (জহুরান বিবি বনাম সোলেমান খান, ১৯৩৩, ৫৮ ক্যাল.জে. পৃষ্ঠা, ২৫১)। তবে দেনমোহর বিয়ের পূর্বে, বিয়ের সময় এমনকি বিয়ের পর নির্ধারণ করা যেতে পারে। (কামরুন্নেসা বনাম হুসাইনি বিবি, ১৮৮০, ৩ অল. পৃষ্ঠা, ২৬৬)।
কিন্তু নির্ধারিত দেনমোহরের পরিমাণ কোন ক্রমেই দশ দিরহামের কম হবে না। (সাহাবুদ্দিন বনাম উমাতুর রসুল, ৬০, এপি, পৃষ্ঠা-৫১১)। স্ত্রী দেনমোহরের দাবীতে মামলা করলে, দেনমোহরের পরিমান বেশী বা স্বামীর সামর্থ্যরে উর্ধ্বে এরুপ কথা স্বামীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অজুহাত হিসেবে গ্রাহ্য হবে না। (সুলতান বেগম বনাম সায়াজ উদ্দিন, ১৯৩৬, ১৬১ আইসি. পৃষ্ঠা, ৩০০)। মোদ্দা কথা হলো, কোনো বিবাহে দেনমোহর ধার্য্য না হয়ে থাকলেও স্ত্রী মর্যাদা মাফিক দেনমোহর পাওয়ার অধিকারিণী। (২০ ডিএলআর, পৃষ্ঠা, ২৭)।
তবে দেনমোহর এত বেশী হওয়া উচিৎ নয় যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আবার এত কম হওয়াও উচিৎ নয় যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে না।
পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় রিপার। রিপার বাবা কৃষক মানুষ লেখাপড়া জানে না। ছেলে ভাল চাকুরী করে এ সংবাদে খুশি হয়েই রিপাকে বিয়ে দেয়। কিন্তু বিয়ে আসরে কাবিনে উল্লেখিত দেনমোহরের অংশটি পরিশোধ না করেই উসুল লিখে দেয়া হয়। বিষয়টি রিপার পরিবার তখন লক্ষ্য করেনি। অবশ্য এক্ষেত্রে দেনমোহর অজ্ঞতাও একটি বড় কারন। পরবর্তীতে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটলে মোহরানা আদায়ের প্রশ্ন আসলে কাবিনে ‘উসুল’ লেখা থাকার কারনে রিপা তার প্রাপ্য দেনমোহর থেকে বঞ্চিত হন।
দেনমোহর দুই প্রকার। একটি তাৎক্ষণিক দেনমোহর, যা স্ত্রীর চাওয়ামাত্র পরিশোধ করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে বিলম্বিত দেনমোহর। বিলম্বিত দেনমোহর বিবাহবিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া স্বামী সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে স্ত্রীকে বিলম্বিত দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। সাধারণত দেনমোহরের কিছু পরিমাণ বিয়ের সময় তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে দেওয়া হয় এবং তা কাবিননামায় লিখিত থাকে। বাকিটা বিলম্বিত দেনমোহর হিসেবে ধরা হয়। স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করে দেনমোহর আদায় করতে পারবেন। দেনমোহর দাবি করার পর স্বামী ওই দাবি পরিশোধ না করলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পৃথক থাকতে পারবেন এবং ওই অবস্থায় স্বামী অবশ্যই তাঁর ভরণপোষণ করতে বাধ্য থাকবেন। (১১ ডিএলআর, পৃষ্ঠা, ১২৪)। এ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে স্ত্রী তাঁর দেনমোহর আদায়ের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করে তা আদায় করতে পারেন। তবে অবশ্যই তালাক হওয়ার তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email: seraj.pramanik@gmail.com