কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্যাস-লাইটার দিয়ে সহায়তা করার কারণেই পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে আইনজীবী পলাশ কুমার রায় নিজের গায়ে আগুন লাগাতে পেরেছেন। কর্মচারীরা পলাশকে কারা ক্যানটিন থেকে লাইটার কিনতে সহযোগিতা করেছেন। কারাগারের ভেতরে একজন বন্দীর কাছে এ ধরনের লাইটার রাখতে দিয়ে দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন জেলার। কারাগারে হাজতি বা কয়েদিদের দেখাশোনার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, সেই কারা কর্মকর্তারা তদারকি ঠিকমতো করেননি বলে পলাশ আত্মহত্যা করেছেন।
পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আইনজীবী পলাশ রায়ের মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রাজশাহী বিভাগের উপমহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটি গঠন করা হয়। পঞ্চগড় কারাগারের জেলার মোশফিকুর রহমান, ডেপুটি জেলার হুমায়ুন কবির হাওলাদারসহ ছয় কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পলাশের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় হাসপাতাল এলাকায় কর্মরত মনজুরুল হাসানের বিরুদ্ধে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার ও ডেপুটি জেলারসহ প্রধান কারারক্ষী সামিউল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সর্বপ্রধান কারারক্ষী একাব্বর আলী, কারারক্ষী ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জড়িত এই ছয় কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কারা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে প্রমাণ হয়েছে তাঁদের গাফিলতি ছিল। এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করে কারা কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয়কে জানাতেও বলা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজতি বন্দী পলাশ কুমার রায় নিজেই তাঁর গায়ে আগুন লাগিয়েছেন। পলাশ তাঁর লাইটার দিয়ে শরীরে আগুন লাগানোর পর দায়িত্বরত কারারক্ষী ইকবাল হোসেন দৌড়ে গিয়ে পলাশের গায়ের জামাকাপড় ছিঁড়ে খুলে ফেলেন এবং আগুন নেভাতে সক্ষম হন। আগুন নেভাতে গিয়ে কারারক্ষী নিজেও আহত হন।
তবে ইকবাল হোসেন, কারারক্ষী সামিউল ইসলাম, কারাপ্রধান একাব্বর আলী দায়িত্বে অবহেলা করেছেন বলে মন্তব্য করেছে কমিটি। কমিটির মতে, ডেপুটি জেলার হুমায়ুন কবির হাওলাদার তাঁদের তদারকির দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করায় পলাশ গায়ে আগুন লাগানোর সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া জেলার মোশফিকুর রহমানের ‘গার্ডিং ফোর্স’ পরিচালনার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন হওয়া ও কারাবিধি যথাযথভাবে মানেননি।
পঞ্চগড় কারাগারের জেলার মোশফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোনো চিঠি পৌঁছেনি, তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়েও জানি না।’
তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, কারাগারে বিড়ি-সিগারেট বিক্রি বন্ধ না করলে গ্যাস-লাইটার বন্দীদের কাছে থাকবেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
পলাশের মৃত্যু সম্পর্কে জেলার বলেন, তিনি যে আত্মহত্যা করেছেন, এটা কারাগারের সবাই দেখেছেন। মৃত্যুর আগে থেকেই তাঁর আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল।
তবে পলাশ আত্মহত্যা করেছেন তা মানতে রাজি নন তাঁর ভাই অমিত কুমার রায়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মৃত্যুর আগে বয়ানে বলে গেছেন প্রতিপক্ষের নৃশংসতার কথা। বলে গেছেন তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। বোতল থেকে কিছু একটা ছুড়ে মারা হয়েছিল তাঁর শরীরে। তারপরও আমরা কী করে বিশ্বাস করি ভাই আত্মহত্যা করেছেন? কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন, পরে মারা গেছেন। কারা কর্তৃপক্ষকেই এ দায় নিতে হবে।’
উল্লেখ্য, গত ২৬ এপ্রিল সকালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত আইনজীবী পলাশ কুমার রায় অগ্নিদগ্ধ হন। ৩০ এপ্রিল দুপুরের দিকে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে ২৫ মার্চ পঞ্চগড়ে একটি মানববন্ধন থেকে তাঁকে আটক করে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তিনি সেখানেই ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার দিনই তাঁকে আরেকটি মামলায় হাজিরার জন্য ঢাকা পাঠানোর কথা ছিল।
মৃত্যুর আগে পলাশ ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে বলেছেন, কারাগারের ভেতরে দুজন লোক তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। মৃত্যুর আগে পলাশের এই বক্তব্য রেকর্ড করেছেন তাঁর ভাগনে প্রসেনজিৎ কুমার রায়। পলাশ ঢাকায় কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানির আইন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রথম আলো