মুহঃ মাসুদুজজামান:
শুনানি চলাকালে লক্ষ্য করলাম এজলাসের পিছনের সারিতে একজন রুগ্ন অল্প বয়সী মহিলা কোলে একটি দুই বছরের বাচ্চা বুকে জড়িয়ে বসে আছে। মামলা শুনানির শেষ পর্যায়ে ভীষণ গরমে যখন বিচারক, উকিল সাহেব ও বিচারপ্রার্থীরা হাঁসফাঁস করছে এবং শুনানী শেষ করে বিচারক এজলাস ত্যাগ করতে যাচ্ছেন ঠিক তখন ঐ রুগ্ন মহিলা পিছনে দাঁড়িয়ে ক্ষিণ কন্ঠে বললেন,
-‘স্যার আমি আবার কবে আসুম? গার্মেন্টস কইরা বাবুরে খাওয়াই, ছুডি পাইনা স্যার!’ দেখি উকিল সাহেব হাজিরা দিলেও ডাকমতে এজলাসে অনুপস্থিত। মামলা একতরফা শুনানি।
মেয়েটিকে ডকে তুলে জবানবন্দি গ্রহণকালে মেয়েটি কেঁদে ফেলে বললো, -‘স্যার আমার বাবু যহন প্যাডে তহন বাবুর বাপে আমারে সন্তান ডেলিভারির জন্য আমার মায়ের বাড়িতে পাডায়া দেয়, হেরপর আর আমারে লয়নাই এবং বাবুর জন্মের পর মুখটাও দেহেনি আইজ পর্যন্ত! পরে হুনছি হ্যায় অন্য এক বেডিরে বিয়া করচে। দুই বছর ধইরা গার্মেন্টস কইরা বাবুরে খাওয়াই!’
বিচারক গরমের মধ্যেও হঠাৎ হিমশিতল হয়ে গেলেন একজন বাবারূপী জানোয়ার এর নিষ্ঠুরতার বর্ণনা শুনে! বাচ্চাটির মায়াবী রুগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম বাবার আদর বঞ্চিত একজন অসহায় শিশু, মেয়েটির কান্নাভেজা মুখ দেখে ও কথা শুনে বুঝলাম ভিষণ কষ্ট পেয়েছে স্বামীর ব্যাবহারে!
আমি সদর পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসেবে মনে মনে বিড়বিড় করে বললাম ঐ শিশুর গার্ডিয়ান তো আদালত এবং তার সুরক্ষা আদালত দেয়ার ব্যবস্থা করবেই, কিন্তু বাবার আদর কীভাবে মিটবে! শিশুটিকে একটু ডেকে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করল কিন্তু বিচারকের চাকরির নিয়ম বেড়াজালে জড়িয়ে আবেগ সংবরণ করে কঠিন ভাব গাম্ভীর্যে এজলাস ত্যাগ করলাম! প্রতিদিন কত জীবনযুদ্ধ বিচারকের সামনে মঞ্চস্থ হয়!
(সিনিয়র সহকারী জজ মুহঃ মাসুদুজজামানের ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগ্রহ)