নিয়োগ দিচ্ছেন জেলা জজ। আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেতন-ভাতা দিচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। চাকরির তাৎক্ষণিক বদলি, পদোন্নতি দিচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। কাজ করতে হচ্ছে অধস্তন আদালতের বিচারকদের অধীনে। ত্রিমুখী কর্তৃত্বের এই যাঁতাকলে পিষ্ট দেশের ২০ হাজারের বেশি আদালত-সহায়ক কর্মচারী। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অংশটি বঞ্চনায় গুমরে কাঁদছে ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর থেকেই। প্ল্যাটফরমহীন এই কর্মচারীরা এখন চেষ্টা করছেন সংগঠিত হতে। চাইছেন ‘বিচার বিভাগীয় কর্মচারী’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে কথা বলতে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের ৬৪টি আদালতে বিভিন্ন পদবির ২০ হাজারের বেশি আদালত-সহায়ক কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে এমএলএসএস, প্রসেস সার্ভার, ক্যাশ সরকার, ক্যাশিয়ার, নিম্নমান সহকারী, ফরাস, দপ্তরি, নাইটগার্ড, বেঞ্চ সহকারী, হিসাব রক্ষক, নাজির, সেরেস্তাদার, সেরেস্তা সহকারী, তুলনাকারক, তুলনা সহকারী, টাইপিস্ট কপিস্ট, স্টেনোটাইপিস্ট, স্টেনোগ্রাফার, কম্পিউটার অপারেটর, রেকর্ড সহকারী, রেকর্ডকিপার, জুডিশিয়াল পেশকারের পদ রয়েছে।
এর বাইরেও কিছু পদ রয়েছে। তারাই দেশের দায়রা জজ আদালত, অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত, যুগ্ম দায়রা জজ আদালত, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিএমএম কোর্ট), অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, অর্থঋণ আদালত। এর বাইরে বেশ কিছু ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। যেমন- প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, বিদ্যুৎ আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, নিরাপদ খাদ্য আদালত, শ্রম আদালত, নৌ আদালত, শিশু-কিশোর আদালত, বন ও পরিবেশ আদালত, বিমানবন্দর আদালত, পারিবারিক আদালত, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, নির্বাহী আদালত এবং গ্রাম আদালতসহ অন্তত ৩০ ধরনের আদালতে কাজ করছেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে লিখিত এবং ভাইভা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে স্বীয় যোগ্যতায় তারা এ নিয়োগ পান। জেলা জজ আদালত তাদের নিয়োগ দেন। তবে আদালতের বিদ্যমান অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, দেশের আদালতগুলোতে কর্মচারীদের অনেক পদই এখনো শূন্য। অথচ মামলার সংখ্যা বাড়ছে। বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে। সেই তুলনায় বাড়েনি সহায়ক কর্মচারীর সংখ্যা। ফলে বিদ্যমান কর্মচারীদের কাজের পরিধি দিন দিন বাড়ছে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র জানায়, মাসদার হোসেন মামলা রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের নভেম্বরে ‘পৃথক বিচার বিভাগ’ যাত্রা করে। এর পরে বিচার বিভাগ কাগজ-কলমে স্বাধীন হলেও কার্যত নির্বাহী বিভাগের অধীনেই থেকে যায়। তবে বিচার বিভাগের জুডিশিয়াল ক্যাডারদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে অনেক। অবকাঠামো সংস্কার, নতুন নিয়োগ, বেতন-ভাতা দ্বিগুণ হওয়া, প্রশিক্ষণ প্রদানসহ নানা দিক থেকে বেশ কিছু অগ্রগতিও সাধিত হয়। পক্ষান্তরে আদালত-সহায়ক কর্মচারীরা বিচার বিভাগের অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিপুলসংখ্যক এই অংশের অধিকার এবং তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি থেকে যায় উপেক্ষিত।
এর ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় সঙ্কট সৃষ্টি হয় কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি, শাস্তি ও পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি এবং অধিকারের প্রশ্নে। জেলা জজ আদালত আদালত কর্মচারীদের নিয়োগ দেন। এই আদালতের অধীন বিভিন্ন আদালতে তারা কাজ করেন। অথচ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন। অন্যদিকে নাজির কিংবা বেঞ্চ সহকারী পর্যায়ের একজন কর্মচারীর বদলির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। অনুমোদন প্রয়োজন হয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের। ত্রিমুখী এই কর্তৃত্বের যাঁতাকলে অধস্তন আদালত কর্মচারীদের এখন ত্রাহি দশা।
সূত্র মতে, বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাও খুব একটা নেই তাদের। একই যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য দফতরের একজন কর্মচারী তাদের দ্বিগুণ বেতন পান। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির শাহ মো. মামুন জানান, ব্যাংকের একজন এমএলএসএস থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই আপ্যায়ন ভাতাসহ পদোন্নতি, সুবিধাদি সমহারে পেয়ে থাকেন।
পুলিশ বিভাগে কর্মরত একজন কনস্টেবল এবং পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা উভয়ে ৩০% ঝুঁকিভাতা, রেশন, পদোন্নতি ও সুবিধা পান। একই যোগ্যতাসম্পন্ন আদালত কর্মচারীরা সেটি পান না। আদালত কর্মচারীরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত; অথচ তারা অর্থনৈতিকভাবে মানবেতর জীবন যাপন করেন। আমরা বিচার বিভাগীয় কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি চাই। এ লক্ষ্যে আমরা সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করে তিন দফা দাবি প্রচার করছি।
ভোলা সিজেএম কোর্টের ক্যাশিয়ার মো. নাজিমউদ্দিন বলেন, আদালত কর্মচারীরা বিচারকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন; অথচ তাদের বিচার বিভাগীয় কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি নেই। বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর বিচারকদের জন্য স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল পে-স্কেল হলেও বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল হয়নি।
ঢাকা সিজেএম কোর্টের কম্পিউটার অপারেটর মো. কামাল হোসেন মর্যাদার বৈষম্য তুলে ধরে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। তিনি গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। অর্থাৎ সে সময় সেরেস্তাদাররাও ‘কর্মকর্তা’র মর্যাদা পেতেন। অথচ এখন তারা ‘কর্মচারী’ হিসেবেই পরিগণিত।
অন্যদের সঙ্গে বেতন-বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে বেতন স্কেল পর্যালোচনায় দেখা যায়, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, অডিটর, সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের মতো দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদার পদগুলোর বেতন স্কেল সেরেস্তাদারদের নিচে ছিল। তারা এখন সেরেস্তাদারদের দ্বিগুণ স্কেলে বেতন পাচ্ছেন।
বর্তমান জনকল্যাণকামী সরকারের কর্মপরিধি বৃদ্ধির ফলে নতুন অনেক বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে। সেসব বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মচারীদের দ্বিতীয় কিংবা প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। খাদ্য পরিদর্শক, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই), নার্স, কৃষির ব্লক সুপারভাইজার, উপজেলা নির্বাচন অফিসারদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে কর্মরত একজন মাধ্যমিক পাস উচ্চমান সহকারী কিংবা প্রধান সহকারীকে তৃতীয় শ্রেণী থেকে সরাসরি প্রথম শ্রেণীর সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে।
ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উচ্চ মাধ্যমিক পাস তহসিলদারকে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা করা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের কর্মচারীদের সঙ্গেও অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বিস্তর বেতন-বৈষম্য রয়েছে। হাইকোর্টের বেঞ্চ অফিসারগণ প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পেয়েছেন। পার্সোনাল অফিসারদের দেয়া হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা। অথচ একই যোগ্যতাসম্পন্ন অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা এখনো তৃতীয় শ্রেণীতেই পড়ে আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুন্সীগঞ্জ আদালতের একজন বেঞ্চ সহকারী জানান, বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের পদোন্নতির বৈষম্য ভয়াবহ। পদোন্নতির যৎসামান্য সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগই ব্লক পোস্ট। পদোন্নতির কোনো সুযোগই নেই। যে ক’টিতে পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে সেই সুযোগ গ্রহণ করতে কর্মচারীকে ২০-২২ বছর অপেক্ষা করতে হয়। চাকরির শেষ সময়ে এসে পদোন্নতি পেলেও অনেকে কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। চাকরি থেকে অবসরে চলে যান অনেকে।
নানামাত্রিক বৈষম্যের শিকার অধস্তন আদালতের কর্মচারী সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন এক নয়। বৈষম্য তো থাকবেই। তারা সেটি মেনেই চাকরিতে যোগদান করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে কী করার আছে? সূত্র : ইনকিলাব