সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অপরাধকাণ্ড সংঘটনের জলজ্যান্ত দৃশ্যের ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করা ভিডিও রেকর্ড টিভি ও ইন্টারনেটে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। দুয়েকটির আবার অপরাধ সংঘটনের প্রচেষ্টা, অভিপ্রায়ের অডিও রেকর্ডও একইভাবে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। চাক্ষুষ প্রমাণ এইসব ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড আদালতে সাক্ষ্য-সবুদ হিসেবে ব্যবহার করলে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করতে বেগ পেতে হয় না বলে কথা উঠেছে। সেইসাথে বিতর্কও উঠেছে এইসব ইলেক্টনিক রেকর্ড আদালতে সাক্ষ্য-সবুদ হিসেবে ব্যবহারের আইনগত সুযোগ নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন সাবেক বিচারক মঈদুল ইসলাম
আদালতে সাক্ষ্য-সবুদ ব্যবহারের নীতি পদ্ধতি বিষয়ে আমাদের দেশে রয়েছে ১৮৭২ সালের এভিডেন্স এ্যাক্ট। এখানে মূলত দু’ ধরনের এভিডেন্সের কথা আছে- প্রথমত হল মৌখিক অর্থাৎ, সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হয়ে যা কিছু বর্ণনা করেন, দ্বিতীয়ত হল ডক্যুমেন্টারি অর্থাৎ, আদালতের নিরীক্ষণের জন্য যেসব ডক্যুমেন্ট উপস্থাপন করা হয়। ডক্যুমেন্ট হিসেবে যে ৫টি উদাহরণ এই আইনের ধারা ৩ এ দেয়া আছে তাতে এখনকার এসব ইলেক্ট্রনিক অডিও বা ভিডিও বা অডিও ভিজুয়াল রেকর্ড নেই। না থাকারই কথা, ১৮৭০ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত স্যার জেমস ফিটজজেমস স্টিফেন সাহেবরা যখন ড্রাফট করেছিলেন তখন এ জাতীয় রেকর্ড যে আগামীতে কখনও আসতে পারে তা কল্পনা করার মতো বাস্তবতা ছিল না। তাই বলে তাঁরা একেবারে অদূরদর্শী ছিলেন সে কথাও বলা যাবে না ডক্যুমেন্টের সংজ্ঞাটি খুঁটিয়ে দেখলে। তাঁদের ড্রাফটিং অনুযায়ী ডক্যুমেন্ট হল- স্মারক হিসেবে ধরে রাখার জন্য কোন অক্ষর, সংখ্যা, চিত্র, চিহ্ন, সংকেত এক কথায় যে কোন রকম আঁকিবুকির মাধ্যমে কোন বস্তু বা পদার্থে ফুটিয়ে তোলা কোন ব্যাপার-স্যাপার। [“Document” means any matter expressed or described upon any substance by means of letters, figures or marks, or by more than one of those means, intended to be used, or which may be used, for the purpose of recording that matter.] এসব অক্ষর, সংখ্যা, চিত্র, চিহ্ন, সংকেতের আঁকিবুকি (letters, figures or marks, or by more than one of those means) কলম দিয়ে, না রঙ-তুলি দিয়ে, না হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে তা নির্দিষ্ট নয়। এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলে আইনের তো কোন আপত্তি দেখি না। অডিও-ভিডিও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের যে হার্ডডিস্ক, মেমোরি বা চিপে ধরে রাখা হয় সেগুলো ‘substance’ এর মধ্যে না পড়ার তো কারণ দেখি না। আমি তো ইলেক্ট্রনিক অডিও বা ভিডিও বা অডিওভিজুয়াল রেকর্ডে ১৮৭২ সালের এভিডেন্স এ্যাক্টের সংজ্ঞায়িত ডক্যুমেন্টের সব উপাদানই দেখছি। উদাহরণগুলোই তো শেষ কথা হতে পারে না।
দালিলিক আর মৌখিক সাক্ষ্যের বাইরে আরেক ধরনের সাক্ষ্যও বিচারকাজে হরহামেসাই ব্যবহার হয়, যেটাকে বলা হয় বস্তুগত বা বাস্তব সাক্ষ্য (Material or Real Evidence), আমাদের আদালত অঙ্গনে যা আলামত নামে সমধিক পরিচিত। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৫ ধারার বিধান অনুযায়ী তদন্তকর্মকমর্তা অপরাধ সংশ্লিষ্ট যে কোন আলামত জব্দ করতে পারেন, করেনও। আর, ১৮৭২ সালের এভিডেন্স এ্যাক্টের ধারা ৬০ এর ২ নং শর্তাংশের বিধান ও ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারের ১৬১ বিধি অনুযায়ী আদালতে বিচারের সময় আলামত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অপরাধকাণ্ড সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রনিক অডিও বা ভিডিও বা অডিওভিজুয়াল রেকর্ড আলামত হিসেবেও গ্রহণ না করবারও কোন যুক্তি দেখি না।
সাক্ষ্য-সবুদ গ্রহণ করার যে সব পদ্ধতি ১৮৭২ সালের এ্যাক্টে দেয়া আছে তা দিয়েই ইলেক্ট্রনিক সাক্ষ্য-সবুদ গ্রহণ করা মোটেও অসম্ভব নয়। তার জন্য তদন্তকর্মকর্তা, আইনজীবী এবং বিচারক মহোদয়দের প্রকৃত বিচারে দৃঢ়চেতা বিচক্ষণতা ও সদিচ্ছার প্রয়োগ দরকার। প্রায় বারো শত আইনের এই দেশে আইন তেমন বাধা হয়নি আমার কাছে, কুটতর্ক না তুললে আসলেই তেমন বাধা নয়।
কিন্তু মুশকিল হল, আমার এই মতের সাথে আমি ছাড়া আর সবাই ভিন্নমত করতে পারেন, এবং আমার বিশ্বাস ভিন্নমতের বিজ্ঞের সংখ্যা বেশিই হবে। পুলিশ কর্মকর্তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামে ক্লাস নিতে গিয়ে একবার তাঁদের একজনের অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম যে তিনি মোবাইলের কল রেকর্ড নাকি এক আদালতে গ্রহণ করাতে পারেন নি। আর, আমি চেয়েও এরকম সাক্ষ্য বা আলামত পাইনি তদন্তকর্মকর্তা সময়মত তা জব্দ না করায়। ‘যত জন তত মত’ বন্ধের জন্যই আইন স্পষ্ট থাকা জরুরী। আইনের অস্পষ্টতার শিকার সচরাচর নিরীহরাই হন, আর ফায়দা পান দুর্জনেরা, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই-ই। ‘জুডিসিয়াল ইন্টারপ্রিটেশনের’ মাধ্যমে আইনের অস্পষ্টতা সুপ্রিম কোর্ট দূর করেন যদি বিষয়টি সে পর্যন্ত যায়। কিন্তু, ততদিনে শুধু তো যমুনায় জলই গড়িয়ে যাবে না, ঘটে যাবে অনেক অনেক বিচারবঞ্চনা। আবার, সুপ্রিম কোর্টের সে সিদ্ধান্ত সব তদন্তকর্মকর্তা, আইনজীবী, বিচারকের তাৎক্ষণিক অবগতিতে থাকেও না। আমাদের দেশে ১৯৮৫ সালে ৩৭ ডিএলআর ২৭৫ পৃষ্ঠায় হাইকোর্ট বিভাগ সেই সময়ের ভিডিও ক্যাসেট ডক্যুমেন্টারী এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। তারও আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এআইআর ১৯৬৪ এসসি ৭২ পৃষ্ঠায়, এআইআর ১৯৬৮ এসসি ১৪৭ পৃষ্ঠায় এবং পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট পিএলডি ১৯৭৬ এসসি ৫৭ পৃষ্ঠায় টেপ রেকর্ডকে ডক্যুমেন্টারী এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। কিন্তু, পরবর্তীকালে এসব সিদ্ধান্ত কাজে লাগাবার নজির খুব একটা পাওয়া যাবে না। তাই, সংশিষ্ট আইনের বিধানগুলোই সুস্পষ্ট থাকা কাম্য।
আইনের আদালত দুয়েকটি সুনির্দিষ্ট ব্যতিক্রম ছাড়া সব সময় সাক্ষ্য চায় আসলটা, তা সে মৌখিক, ডকুমেন্টারী বা আলামতই হোক। সাক্ষ্য-সবুদে নকলবাজি, জালিয়াতির ব্যাপার আগেও ছিল, এখনও আছে। এখনকার ডিজিটাল যুগে ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তিতে এই নকলবাজি, জালিয়াতির সুযোগ আরও প্রশস্ত। তাই, ইলেক্ট্রনিক সাক্ষ্য-সবুদ গ্রহণ করার পদ্ধতি, আসলটা না থাকলে কী ধরনের কপি কিভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, আসল-নকলের ফারাক বোঝার কী উপায় হবে এসব বিষয় আইনে সুনির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন। ভারত ২০০০ সালে যখন ইনফরমেশন টেকনলজি এ্যাক্ট করে তখনই ১৮৭২ সালের এভিডেন্স এ্যাক্টের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংশোধন করে ডিজিটাল যুগোপযুগী করে নিয়েছে। শুধু এভিডেন্স এ্যাক্টই নয়, ১৮৬০ সালের পেনাল কোড, ১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুকস এভিডেন্স এ্যাক্টও একই সাথে সংশোধন করে নিয়েছে ঐ ইনফরমেশন টেকনলজি এ্যাক্ট দিয়েই। ঐ সময় ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি থাকলে স্টিফেন আর মেকলে সাহেবরা যা করতেন ভারত তাই করে নিয়েছে। আমাদের দেশে তথ্য প্রযুক্তি আইন হয়েছে ২০০৬ সালে। তখনই আমাদের এভিডেন্স এ্যাক্ট, পেনাল কোড, ব্যাংকার্স বুকস এভিডেন্স এ্যাক্ট ইত্যাদি ডিজিটাল যুগোপযুগী করে ফেলার কথা। কিন্তু, তা হয় নি। তারও পরে দীর্ঘ সময় চলে গেছে, চলে যাচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক সাক্ষ্য-সবুদের গ্রহণযোগ্যতা ও গ্রহণপ্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য আমাদের আইনগুলোর সংশোধনও এখনই প্রয়োজন।
লেখক: সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং দুদকের সাবেক মহাপরিচালক; ই-মেইল: moyeedislam@yahoo.com