শরিফুল ইসলাম সেলিম:
বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের দ্রুত উৎকর্ষসাধনের ফলে মানুষের জীবনের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি। মানুষ তার প্রত্যহিক জীবনের প্রয় সকল কাজই করছে প্রযুক্তির ব্যবহার বা সহযোগীতায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে যে, সুদক্ষ অপরাধীরাও তাদের অপরাধ কর্ম সাধনের নিজের অজান্তেই রেখে যাচ্ছে তার ছাপ। গাইবান্ধার সাবেক সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যায় একই আসনের সাবেক সাংসদ আবদুল কাদের খানের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির বদৌলতে। এছাড়াও বর্তমানে প্রচুর অপরাধ ঘটছে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। যেগুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়ে যাচ্ছে সেই ইন্টারনেট ও সংশ্লিষ্ট ডিভাইসগুলোতেই। যেমন কোনো ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি বা চাঁদার জন্য ভীতি প্রদর্শন আমাদের দন্ডবিধির অধীনে গুরুতর অপরাধ। এখন কোনো ব্যক্তি যদি এই অপরাধগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে, ই-মেইল বা মোবাইলের মাধ্যমে ঘটিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে সংশ্লিষ্ট কোনো স্ক্রিনশট কিংবা মোবাইলের অডিও রেকর্ড। আবার কখনো কখনো সংঘটিত অপরাধের প্রমাণ কেবল অডিও-ভিডিও কিংবা ছবি ছাড়াও অন্য কোনো মাধ্যমে থেকে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আদালত ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স কিভাবে আমলে নিবে তার উপরে নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার। কেননা, এরকম বহু ক্ষেত্রই তৈরি হতে পারে, যেখানে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স ছাড়া আর কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করাই সম্ভব না।
বিশ্বের যেসব দেশে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অনেক বেশি, সেসব দেশের আদালত ডিজিটাল আলামত গ্রহণ করতে গিয়ে নানা সময় নানা রকম বিভ্রান্তির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। যেমন : ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স খুব সহজেই টেম্পার করা যায়। আধুনিক গ্রাফিক্স অ্যানিমেশন খাতে যে বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই নিপুণভাবে একটি ছবি, অডিও বা ভিডিওকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা সম্ভব। একটি ছবি বা ভিডিও ক্লিপে একজনকে নতুন করে সংযোজন, ছবি বা ভিডিও ফুটেজ থেকে একজনকে সরিয়ে দেয়া কিংবা অডিও ক্লিপে একজনের কণ্ঠকে অন্যজনের কণ্ঠ দিয়ে পরিবর্তন করা এখন খুব কঠিন কিছু নয়। বর্তমানে এরকম প্রচুর সিনেমা তৈরি হচ্ছে, যেগুলোয় গ্রাফিক্স ও অ্যানিমেশনের এত নিখুঁত কাজ করা হয়েছে, অসম্ভব সব শটকে প্রযুক্তির সহযোগিতায় সম্ভব করা হয়েছে। এরকম ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সকে আদালত যদি সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে, সে ক্ষেত্রে বহু বহু ক্ষেত্রে আদালতকে বিভ্রান্ত করা হতে পারে। আমাদের দেশের আদালতগুলো এখন পর্যন্ত প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনে অনেক অনেক পিছিয়ে। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশের আদালতে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স গ্রহণ করার আগে নানা বিষয় ভাবনাচিন্তা করে নিতে হবে।
বাংলাদেশের আইন-আদালতে ডিজিটাল আলামত
বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইনে সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রধানত দুই রকমের যথা, মৌখিক ও দালিলিক। ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সকে আদালতে উপস্থাপন করতে হলে দালিলিক সাক্ষ্য (ডকুমেন্টারি অ্যাভিডেন্স) হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। এখন বিভিন্ন আইনে দলিল বা ডকুমেন্ট শব্দের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তার অধীনে ডিজিটাল সাক্ষ্যকে আনা যায় না। যেমন সাক্ষ্য আইনের ৩ ধারায় দলিল বলতে কোনো বস্তুর ওপর অক্ষর, অঙ্ক অথবা চিহ্নের সাহায্যে বা এই পন্থাগুলোর একাধিক পন্থায় বর্ণিত অথবা ব্যক্ত কোনো বিষয়, যা লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ওই পন্থা ব্যবহারের জন্য অভিপ্রেত অথবা ব্যবহৃত হতে পারে। আবার দন্ডবিধির ২৯ ধারায় দলিল বলতে অক্ষর, অঙ্ক বা চিহ্নের সাহায্যে অথবা ওই পন্থাগুলোর একাধিক পন্থায় কোনো বস্তুর ওপর ব্যক্ত অথবা বর্ণিত যে কোনো বিষয় বোঝায়, যা ওই বস্তুর প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের জন্য অভিপ্রেত বা যা ওই বস্তুর প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। জেনারেল ক্লজেজ অ্যান্ট অনুসারে দলিল বলতে যে কোনো লিখিত চিঠির মাধ্যমে যে কোনো বস্তুর ওপর ব্যক্ত বা বর্ণিত বিষয়, সংখ্যা বা চিহ্ন অথবা ব্যবহৃত হবে ওগুলোর এক বা একাধিক উপায়ের দ্বারা অথবা ওই বিষয়ে লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যা ব্যবহৃত হবে, তাকে বোঝায়।
এই আইনগুলোয় প্রদত্ত সংজ্ঞার অধীনে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সকে দলিল হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা যায় না। মূলত এই আইনগুলো এমন একটা সময়ে প্রণীত, যখন পৃথিবীতে ডিজিটাল আলামতের ধারণা ছিল না বললেই চলে।তবে সম্প্রতি যে আইনগুলো প্রণীত হচ্ছে, সেগুলোর কোনো কোনোটিতে ডকুমেন্ট বা দলিলকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সও তার মধ্যে আত্মীকৃত হয়ে যায়। যেমন ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবত অন্য কোনো আইনে কোনো তথ্য বা অন্য কোনো বিষয় হস্তাক্ষর, মুদ্রাক্ষর বা অন্য কোনোভাবে লিখিত বা মুদ্রিত আকারে লিপিবদ্ধ করার শর্ত থাকলে, ওই আইনে অনুরূপ বিধান থাকা সত্ত্বেও ওই তথ্য বা বিষয় ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে লিপিবদ্ধ করা যাবে। এই আইনের বদৌলতে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স বা ইলেক্ট্রনিক অ্যাভিডেন্সকে সাধারণ সাক্ষ্যপ্রমাণের সমতুল্য হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই আইনের ২ ধারা ও ৫৪ ধারায় মোট ৪৭ টি টেকনিক্যাল শব্দকে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা ডিজিটাল মাধ্যমে সংগঠিত আলামত সমূহকে একটি সুদৃঢ় আইনি ভিত্তি প্রদান করেছে। এছাড়াও ৮৭ ধারায়কতিপয় আইনে ব্যবহৃত কতিপয় সংজ্ঞার বর্ধিত অর্থে প্রয়োগ “(ক) Penal Code, 1860 (Act No. XLV of 1860) এর section 29 এর “document” এর সংজ্ঞায়িত অর্থে কোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র বা কৌশল দ্বারা সৃষ্ট document ও অন্তর্ভুক্ত হইবে; (খ) Evidence Act, 1872 (Act No. I of 1872) এর section 3 এর “document” শব্দের সংজ্ঞায়িত অর্থে কোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র বা কৌশল দ্বারা সৃষ্ট document ও অন্তর্ভুক্ত হইবে; (গ) Banker’s Books Evidence Act, 1891 (Act No. XVIII of 1891) এর section 2 এর Clause (3) এর “bankers books” এর সংজ্ঞায়িত অর্থে কোন ব্যাংকের স্বাভাবিক ব্যবসায়ে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র বা কৌশল দ্বারা সৃষ্ট ও ব্যবহৃত ledgers, day-books, cash-books, account-books and all other books ও অন্তর্ভুক্ত হইবে৷” মর্মে বলা হয়েছে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ২ (ঘ) এ ‘‘পর্নোগ্রাফি সরঞ্জাম’’ অর্থ পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, ধারণ বা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ক্যামেরা, কম্পিউটার বা কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, অপটিক্যাল ডিভাইস, ম্যাগনেটিক ডিভাইস, মোবাইল ফোন বা উহার যন্ত্রাংশ এবং যে কোনো ইলেক্ট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্য কোন প্রযুক্তিভিত্তিক ডিভাইস বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ৩০ ধারায় অডিও ভিস্যুয়াল যন্ত্র বা কোন ইলেকট্রনিক যোগাযোগের মাধ্যমে ধারণকৃত সাক্ষ্য প্রমাণ ট্রাইব্যুনালের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য (admissible) হইবে বলে উল্লেখ আছে।
মিসেস খালেদা আক্তার বনাম রাষ্ট্র মামলায় আদালত অডিও-ভিডিও ক্লিপ এবং স্থিরচিত্রকে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০২ সালের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ও আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইনে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সকে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।এছাড়াও ১৯৯১ সালের মূল্য সংযোজন কর আইনে কাগজ বা অন্য কোনো পদার্থের ওপর অক্ষর, অঙ্ক, সঙ্কেত বা চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশিত বা বর্ণিত কোনো বিষয় এবং যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক উপাত্ত, কম্পিউটার কার্যক্রম, কম্পিউটার ফিতা, কম্পিউটার ডিস্ক বা যে কোনো ধরনের উপাত্ত ধারক মাধ্যম দলিল বা ডকুমেন্ট হিসেবে গণ্য হবে। ফলে বাংলাদেশের আইনে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের কোনো আইনগত বাধাই নেই।
আদালতের প্রায়োগিক সমস্যা
দালিলিক সাক্ষ্য আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, সাক্ষ্যটি প্রাথমিক (প্রাইমারি) নাকি দ্বৈতীয়িক (সেকেন্ডারি) সাক্ষ্য। আদালতে প্রাথমিক সাক্ষ্যই উপস্থাপনের নিয়ম। তবে কিছু কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্রে দ্বৈতীয়িক সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়। এ ব্যাপারে যে বিস্তারিত নিয়মকানুন বর্ণিত আছে সাক্ষ্য আইনের ৬২ ও ৬৩ ধারায়, সেগুলো ডিজিটাল আলামতের কথা মাথায় রেখে প্রণীত হয়নি। ফলে ডিজিটাল আলামতের কোনটি প্রাথমিক সাক্ষ্য আর কোনটি দ্বৈতীয়িক সাক্ষ্য সে ব্যাপারে আদালত দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর পড়ে যায়। একটি ডিজিটাল অ্যাভিডেন্সকে আদালতে কোন প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করতে হবে এবং এটি আসল নাকি নকল সেটি কীভাবে যাচাই করা হবে এখন পর্যন্ত কোনো আইনে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত কার্যবিধি না থাকায় আইনে ডিজিটাল আলামতের স্বীকৃতি থাকলেও আদালতগুলো এ ধরনের সাক্ষ্য গ্রহণে বিব্রতবোধ করে থাকে। আবার কোন মামলায় তথ্য প্রযুক্তির সম্পৃক্ততা থাকলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একটা মজ্জাগত ধারনা হয়ে দাড়িয়েছে উক্ত মামলাটি তথ্য প্রযুক্তি আইনে করতে হবে, যা মোটেও সমীচীন নয়। যার কারনে দন্ডবিধির ২৯ ধারাকে সংশোধন করা জরুরী। শুধুমাত্র এই একটি সংগাকে পরিবর্তনের মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাকে নিয়ে উদ্ভুত সমস্যাসমুহকে এড়ানো সম্ভব।
কানাডা, ভারতসহ উন্নত দেশগুলোয় ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স গ্রহণের বিষয় বিশদ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং আদালতের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমাদের দেশেও তেমনটি করা সম্ভব হলে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স গ্রহণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে এবং ন্যায়বিচার গতি পাবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : তদন্ত কর্মকর্তা, কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিজ(সিসিএ), তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ(আইসিটি), ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়।