আইমান রহমান খান:
প্রতি বছর মাত্র ৪টা কোর্স থাকলেও ব্রিটিশ ল’ পড়া ছিল আমার জন্য ব্যাপক চ্যালেঞ্জিং। পরীক্ষা হত বছরে একবারই। তাই পড়াশোনাটাও করতে হত খুব মনোযোগ সহকারে। সারাবছর পড়লেও, চর্চা না থাকলে শেষ মূহুর্তে যেকোন বিপদ ঘটা ছিল অনিবার্য।
সুতরাং প্রতিটি শিক্ষার্থী লিপ্ত হত দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায়। বাবা-মা’র মতে, ফেল করা যাবেনা কোনভাবেই। ফেল করলে তো পুরা একটা বছর পিছিয়ে যেতে হবে। অথচ দেশীয় এলএলবি তে তখন চলছে সেমিস্টার পদ্ধতি। কিন্তু আমার এবং আমার সহপাঠীদের বেলায় তা ছিল ভিন্ন।
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫০ টার মত কোর্স করতে হয় ৪ বছর ধরে। সেমিস্টার সিস্টেম থাকলেও পুরা ৪ বছর জুড়ে একজন আইন শিক্ষার্থীকে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমি হতে হয়। এই কোর্স গুলা স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন করতে পারলেই একজন এল এল বি ডিগ্রি অর্জন করতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে তিন বছরের এলএলবি সম্পন্ন করে বার কাউন্সিলে নিবন্ধিত হব সিদ্ধান্ত নেই। টানা তিন বছর পরিশ্রম শেষে মুখোমুখি হলাম এক নতুন চ্যালেঞ্জ এর সাথে। বাংলাদেশি আইন। দেশীয় এলএলবি যারা এর আগে সম্পন্ন করে এসেছে তাদের কাছে কিছুটা পরিচিত হলেও, আমার কাছে তা সম্পূর্ণ নতুন। পরিস্থিতি ছিল অনেকটা ‘ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান’।
৭ টা আইন এবং ৩ ধাপের পরীক্ষা। ৭টা আইন মানে ৭টা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ও ব্যাখ্যাসমূহ। শত শত আইনের ধারা আর আদেশ ভাল মত মনে রেখে ১ ঘন্টার একটি নৈর্ব্যত্তিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। মাত্র ৫ বছর আগে এডভোকেট তালিকাভুক্তকরণ পরীক্ষায় প্রিলি মাধ্যমটি চালু হয়। এর আগে শুধু লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা ছিল। ১০০ মার্কের এই এমসিকিউ (MCQ) পরীক্ষায় ৫০ নম্বর পেলেই একজন পরের ধাপে এগুতে পারবে। তবে প্রতি চারটি ভুল উত্তরে ১ মার্ক করে কাটা যাবে।
গতবারের প্রিলি (MCQ) পরীক্ষায় যুক্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা সমূহ। তুলনামূলক ভাবে এবারের প্রশ্নপত্র ছিল গতবারের চেয়ে কঠিন। একদম ভাল প্রস্তুতি ছাড়া এমন পরীক্ষায় পাশ করা দুরূহ ব্যাপার।
এবার আসি লিখিত পরীক্ষায়। এই পরিক্ষায়ও সেই আগের ৭টা আইনের বিষয়ের উপরই নেওয়া হবে। তবে এটাতে উত্তর লেখার সুযোগ আছে। সাথে আছে কিছু জটিল প্রয়োগিক প্রশ্ন। দেওয়ানি মামলার আরজি আর ফৌজদারি মামলার ড্রাফটিং এর পদ্ধতি ভালভাবে আয়ত্তে আনতে হবে (যা আমার এল এল বি কোর্স এ পাইনি, তাই নতুন করে শিখতে হচ্ছে)
লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে নিজের হাতে নোট করার কোন জুড়ি নেই। যে যত নিজের ভাষায় নোট করবে, তার পাশ করার সম্ভাবনা তত বেশি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পরীক্ষার ঠিক এক মাস আগে নিজের লেখা নোট পড়তে হবে এবং আবারো নতুন করে লেখতে হবে। তবে তা হবে, না দেখে লেখা। তখনই উত্তর হবে ‘টু দ্য পয়েন্ট!’
লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে হলে একজন ছাত্র কে সর্বনিম্ন ২ মাস কঠর অনুশীলন করতে হবে। আগের পরীক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞান এ পরীক্ষায় প্রয়োগ করতে হয়। এখানে সব এনালাইটিকাল ধাঁচের প্রশ্ন যা যাচাই করবে একজন ছাত্রের আইনি বুদ্ধি।
এমসিকিউ (MCQ) আর লিখিত (Written) পরীক্ষায় পাশ করলেই একজন ছাত্র ভাইভা বোর্ড ফেইস করার টিকেট পাবে। আর ভাইভা বোর্ড যেনতেন কেউ না, স্বয়ং হাইকোর্টের বিচারপতিদের সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং প্রিপারেশন হওয়া চাই ১০০ তে ১০০। আইনি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্মুখীন হয়ে নিজের জ্ঞানের পরিচয় দেয়া সত্যিকারের সাহসিকতা। এই কথার গুরুত্ব শুধু সেই জানে, যে এমন মুহূর্ত পার করে এসেছে।
দুই দুইটা পরিক্ষায় পাশ করে আর মৌখিক পরিক্ষায় বোর্ড কে সন্তুষ্ট করতে পারলেই, একজন নিম্ন আদালতে আইন পেশা শুরু করার অনুমোদন পায়। তারপরই সে আসল যুদ্ধের ময়দানে কেবল প্রথম পা ফেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
একজন আইনজীবীর প্রথম পদচারণা নিম্ন আদালত দিয়ে শুরু হলেও তার জন্য খুলে যায় অপার সম্ভাবনার দুয়ার। এই পেশার প্রতিটি মানুষ একজন যোদ্ধা যারা সাদা কালো পোশাকে প্রতিদিনই লড়ে যাচ্ছে মানুষের অধিকার আদায়ে। তাই বলি, আজ আইন পেশা যদি এতটাই সহজ হত, পৃথিবীতে আর কোন জীবিকার পন্থা তৈরি হত না।
লেখক : অ্যাডভোকেট ও এক্রিডিটেড মেডিয়েটর