সিরাজ প্রামাণিক:
আইন পেশার সুবাদে বৈচিত্র্যময় মক্কেলের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এইতো সেদিন একজন নারী মক্কেল তার নিজের জীবন কথা বলল। সে কথাগুলো চিঠি আকারে লিখে আমার চেম্বারে রেখে গেল, আর বলল ‘এ চিঠি যতদিন থাকবে, আমার কথা আপনার মনে থাকবে।’ চিঠিখানা হারিয়ে গেলেও তার কথা আমি ভুলি কি করে? জানি, স্বল্প সময়ে একজন মানুষের জীবন সবটুকু জানা যায় না। একজন মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা অজানা কথা আরেকজন পুরোপুরি বলতে পারে না। তারপরও আমি যাঁর কথা বলতে চেষ্টা করেছি, সে ধৃষ্টতার জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা চাই। লেখায় সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে ভূক্তভোগীর নাম গোপন রাখা হয়েছে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু কখনও কখনও তা অভিশাপ রূপে দেখা দেয়। সুমির (ছদ্মনাম) জীবনেও এমনটি ঘটেছিল। শহরে নিজের বাড়ি, শিক্ষিত স্বামী শোভন চৌধুরী (ছদ্মনাম) আর তিন সন্তান নিয়ে সুখের পরিবার। প্রত্যাশার চাইতেও যেনো অনেক বেশী স্বপ্নবিলাস। হঠাৎ এক ঝটিকা দমকা হাওয়া এসে যেন সবকিছু তছনছ করে দেয় এ দম্পত্তির।
হঠাৎ একদিন রাতে শোভন চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। যাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিলেন, তিনি ছিলেন সদ্য-তালাকপ্রাপ্ত, ৪ সন্তানের মা। খুব কষ্টে সৃষ্টে নাকি দিন কাটছিলো উনাদের। শোভন চৌধুরীর ভাষায়, তাদের অবস্থা এতোটাই শোচনীয় যে দুপুর হলে তার বাচ্চাদের জন্য কোথা থেকে খাবার আসবে সেটাও নাকি তার জানা নেই। সুমির সোজাসাপটা জবাব, কেন? ওদের বাবা কোথায়? সে কি নিজের বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারছে না? বাইরের মানুষ হয়ে কেন অন্য এক লোকের বোঝা টেনে বেড়াতে যাবে? নিশ্চয়ই ওই মহিলা ও তার সন্তানদের সাহায্য করার আরও অনেক উপায় আছে। তার স্বামী চাইলে তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু বিয়ে করার কী প্রয়োজন!
অস্থির হয়ে উঠে সুমি।“কেন? তাহলে আমি কি খারাপ? আমি কি যথেষ্ট ভালো নই? না, না,না! আমি কখনোই দ্বিতীয় একজন স্ত্রীকে মেনে নিতে পারি না। যদি তুমি আরেকজন মহিলাকে বিয়ে করতে চাও, তো করো; কিন্তু মনে রেখো ফিরে এসে তুমি আমাকে আর এখানে দেখতে পাবে না।” এরকম হাজারো প্রশ্ন হৃদয়ের মনিকোঠায় উদিত হতে থাকে সুমির।
আসলে বহুবিবাহ মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা সুমি কল্পনাও করতে পারছিল না! নিজের স্বামীকে আরেকজন নারীর সাথে ভাগাভাগি করতে হবে। তার ভালোবাসা, হাসি, রসিকতা এগুলো আরেকজন নারী উপভোগ করবে? স্বামী আরেকজন নারীকে স্পর্শ করবে, আর তাকে ভালোবাসার কথা শোনাবে! অসম্ভব। এটা মেনে নেওয়া যায় না। চরম ক্ষোভ, দুঃখ, আর অপমানের জ্বালায় সুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার ভাষায় আমি ওর জন্যে কী না হইনি? একজন স্ত্রী, প্রেমিকা, মা, সেবিকা, গৃহিণী। আমি ওর তিনটা বাচ্চার মা! কীভাবে পারলো ও আমাকে এতোটা অপমান করতে? মনে হচ্ছিলো আমি হয়তো দেখতে বেশি সুন্দরী না কিংবা অল্পবয়সী না। কিংবা আমি যেন ওর জন্য যথেষ্টই না! এজন্যই দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলছে।
এত স্বপ্ন, কল্পনা, আবেগ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না সুমি। তাই স্বামীকে তীব্র কন্ঠে জানিয়ে দেয়, যদি কোন দ্বিতীয় স্ত্রী এই বাড়িতে প্রবেশ করে, তাহলে সে বেরিয়ে যাবে। যদিও অন্য এক নারীর জন্য শোভন চৌধুরী তাদের বিয়ে, সন্তান, আর জীবনের ঝুঁকি নিতে চায়, তো নিক। কিন্তু সুমি এসব মোটেই সহ্য করবে না।
আমি যখন এ গল্পটি লিখছি, মনে হচ্ছে যেন কতোকাল আগের কথা বলছি! আমি সুমির পক্ষে তার স্বামীকে আইনী নোটিশ প্রদান করি। সার্বিক বিষয় উল্লেখ করি। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ আইনের ধারা ৬ মতে, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সালিশি পরিষদের নিকট থেকে অনুমতি না নিলে বিয়ে নিবন্ধন হবে না। অনুমতির জন্য ২৫ টাকা ফি দিয়ে সাদা কাগজে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে এবং আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ের অনুমতি প্রদানে যে সব বিষয়ের প্রতি বিবেচনা করা হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো: ১) বর্তমান স্ত্রীর বন্ধাত্য ২) দৈহিক দৌর্বল্য ৩) দাম্পত্য জীবন সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা এবং ৪) দাম্পত্য অধিকার পুনর্বহালের জন্য কোনো উম্মত্ততা।
কোনো পুরুষ যদি সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন তবে তিনি অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের আশু বা বিলম্বিত দেন মোহরের সম্পূর্ণ টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করবেন এবং মোহরানার টাকা পরিশোধ করা না হলে বকেয়া ভূমি রাজস্ব আদায়ের মতো আদায় করা হবে। এছাড়াও অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে ১ বছর পর্যন্ত জেল ও ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পাশাপাশি দণ্ডবিধির ৪৯৪-এর বিধান মতে, স্বামী যা স্ত্রীর জীবনকালে পুনরায় বিয়ে করেন তবে সে ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা উচিৎ, বহু বিবাহের মামলায় বাদীকে সফল হতে হলে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, দ্বিতীয় বিয়ের সময় প্রথম বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব ছিল।
অবশেষে সুমির স্বামী আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। অতো শত হুমকি আর আইন-আদালতের ভয় দেখানোর পর বহুবিবাহের কথা আর ধোপে টেকেনি। তবে সেই মহিলা ও তার বাচ্চাগুলোর শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিলো, সে কথা আর জানা হয়নি। বোধ হয় ওরা সবাই অন্য কোন এক শহরে চলে যায়।
এরপর থেকে সুমির স্বামী আর কখনোই দ্বিতীয় স্ত্রী কথাটি উচ্চারণ করেননি, যার কারণে সুমি খুব খুশি। নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে পারার আনন্দে আত্মহারা সে! কিন্তু সুমি তখনও জানত না তার সুখের সময় খুব শীঘ্রই ফুরিয়ে আসছে..।
সুমির স্বামী শোভন চৌধুরীর জীবনের শেষ কথাগুলো ছিলো- ওর খুব মাথা ধরেছে, ইশার সালাতের আগ পর্যন্ত নাকি শুয়ে থাকবে। হায়! ওর আর সে রাতে ইশার সালাত আদায় করা হয়নি, কারণ ওর সে ঘুম আর ভাঙেনি। সে রাতেই উনি মারা যান। ওর আচমকা মৃত্যুতে সুমি পুরো হতবিহ্বল হয়ে পরে! যে মানুষটার সাথে সুমি সারাটা জীবন কাটিয়েছে, তাকে এক মুহূর্তের মধ্যে সুমির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো! এরপর কতোকাল ধরে যে ওর জন্য কেঁদেছে তা কেউ জানেনা.. হয়তো বা এক মহাকাল জুড়ে কাঁদতে হবে।
শোভন চৌধুরীর মৃত্যুর পর কোনকিছু দেখাশোনা করে রাখার মতো অবস্থা সুমির ছিল না। অযত্নে অবহেলাতে একে একে সব হারাতে শুরু করে সুমি। প্রথমে তাদের গাড়ি, এরপর দোকান, এরপর বাড়ি ও অন্যান্য ব্যবসায়ী সামগ্রী।
শেষমেষ তিন সন্তানকে নিয়ে অসহায় হয়ে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠে সুমি। হঠাৎ এতোগুলো মানুষের উপস্থিতিতে ওদের বাড়িটা গিজগিজ হয়ে উঠে। সুমির ভাবীও দিনে দিনে অতীষ্ঠ হয়ে উঠছিলেন। সুমির মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হতো ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। সে সময় সুমির দরকার ছিল একটি চাকরি, কিন্তু ওর তেমন কোন দক্ষতা ছিল না। বয়সও হয়ে গিয়েছে। কিছু শিখে চাকরি করতে পারার মতো বয়সও ছিল না। কিন্তু মানুষের দয়ায় এভাবে কতোদিন মাথা গুঁজে পড়ে থাকা যায়? নিজেদের জন্য একটি আলাদা বাসার প্রয়োজন খুব বেশি করে অনুভব করছিল সুমি।
সুমির কল্পনায় ভেসে উঠে অতীত জীবনের কথা। “যখন আমার স্বামী বেঁচে ছিলেন, আমরা কতো আরামে ছিলাম! ঘরের বাইরে যেয়ে কাজ করার প্রয়োজনই ছিল না, তাই নিজেকে কোন বিষয়ে পারদর্শী করে তোলাও জরুরি মনে হয়নি। কিন্তু উনি চলে যাওয়ার পরে জীবন এতো কঠিন হয়ে গিয়েছিলো! আমি প্রতিটা দিন উনার অভাব বোধ করতাম, হৃদয়ের প্রতিটা অংশ দিয়ে উনাকে খুঁজে ফিরতাম। কী করে মানুষের জীবন এতো ভয়ানকভাবে পাল্টে যায়?”
এভাবেই দিন কাটছিলো সুমির। হঠাৎ একদিন সুমির ভাই ডেকে তার পরিচিত এক ভাইয়ের কথা বললেন। সেই ভাই নাকি বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। ভালো মানুষ, চমৎকার আচার ব্যবহার, আর অনেক দ্বীনদার। সুমির জন্যে নাকি খুব মানাবে! কিন্তু উনি চান সুমি উনার দ্বিতীয় স্ত্রী হোক। এবার সুমির মাতায় বিনামেঘে বজ্রপাত ঘটল। তার জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো দ্বিতীয় স্ত্রী কথাটি শুনলেন, কিন্তু এবারে পরিস্থিতি কতো ভিন্ন!
সত্যি উনি সুমিকে দেখতে একদিন তার ভাইয়ের বাসায় এলেন। ক্ষণিকের মাঝেই যেন তাদের মধ্যে কী একটা হয়ে গেলো! অবিশ্বাস্যভাবে সুমির উনাকে খুব পছন্দ হয়ে গেলো, উনার প্রতিটা ব্যাপারই খুব ভালো লাগছিলো। উনি সুমিকে বললেন, তার প্রথম স্ত্রী জানেন যে তিনি দ্বিতীয় বিয়েতে আগ্রহী, আর স্পষ্টতই তার স্ত্রী এর বিপক্ষে। তিনি এটাও বললেন যে, দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে একজনকে খুঁজে পেয়েছেন জানলে উনার স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেটা তার জানা নেই; তবে উনার স্ত্রীর বহুবিবাহ মেনে নেওয়ার ওপরই এখন উনার চূড়ান্ত জবাব নির্ভর করছে।
সে রাতে সুমি তাহাজ্জতের সালাত আদায় করলেন। সুমি পাগলের মতো চাচ্ছিল যেন বিয়েটা ঠিকঠাক হয়ে যায়! কিন্তু তার মনে পড়ল, অনেক বছর আগে আরেকজন নারীর জীবনও ঠিক এরকম করেই তার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছিলো। মনে পড়ে গেলো, তিনি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হঠাৎ করে অনুতাপে পুড়ে যাওয়ার মতো একটা উপলব্ধি আসলো সুমির। তার মনে হচ্ছিলো তিনি তো জীবনে আরেকজন নারীকে স্থান দেইনি, তাহলে আল্লাহ কেন তাকে আরেকজন নারীর জীবনে স্থান নেওয়ার সুযোগ দেবেন? নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তাকে শাস্তি দেবেন। সুমি বারবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকলেন। কিন্তু অবাক লাগছিলো! জীবনে একবারও তার মনে হলো না যে সে যে কাজটি করছি তা কতোটা ভুল?
সুমির ভাষায় “আমি আমার সম্পদকে, ইজ্জতকে, আমার জিনিসকে আগলে রাখছি -এতে সমস্যা কোথায়? কিন্তু এখন যখন আমার অবস্থান পাল্টে গেছে, প্রয়োজনটা যখন এবার আমার, তখন আমি বুঝতে পারলাম কতোটা ভুল-ই না আমি ছিলাম! আমি আরেকজন নারীর স্বামী পাবার অধিকারকে অস্বীকার করছিলাম।”
এবার সুমি দু’আ করতে থাকলেন যেন উনার স্ত্রী তাকে মেনে নেন..। কয়েকদিন পর সুমির হবু স্বামী তাকে ফোন করলেন। বললেন, উনার স্ত্রীর এটা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে, তবুও তিনি সুমির সাথে দেখা করতে আগ্রহী।
সুমি দেখা করতে গেলেন। খুব চিন্তা হচ্ছিলো তার। সেদিন আল্লাহর কাছে অনেক দু’আ করলেন আর বললেন- হে আল্লাহ, আমাকে সাহায্য করো! যখন তাকে দেখলেন, বুঝতে পারলেন, সে ঠিক সুমির মতোই একজন। একজন স্ত্রী যে তার স্বামীকে খুব ভালোবাসে, যে তার স্বামীকে হারাতে ভয় পায়!
তার চোখগুলোয় বেদনা ছলছল করছিলো। সে সুমির হাত দুটো ধরে বললো: “বোন, আমার জন্য এটা মেনে নেওয়া কী যে কঠিন! তাও দু’আ করি যেন আমরা দু’ জন বোনের মতো থাকতে পারি।”
উনার কথায় সুমির হৃদয় ভেঙে গেলো! তার এই কঠিন সময়ে শুধু এটুকুই পাওয়া- একটি সখ্যতার হাত যে তাকে বুকে টেনে নেবে, তাকে আশা দেবে, বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা ফিরিয়ে আনবে। উনার স্ত্রীর জন্য সেটুকু সুমি পেলেন। উনার স্ত্রী সুমির জীবনে এমন একজন নারীর দৃষ্টান্ত, যেমন নারী সে নিজে কখনো হতে পারি নি। সুমির ভাষায় আমি উনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। একসময় সুমি ভাবত কেউ কারো স্বামীকে নিশ্চয়ই তার মতো করে এতো বেশি ভালোবাসতে পারে নি। কিন্তু উনার স্ত্রীকে দেখে সুমির ধারণাটি বদলে গেলো। এই মানুষটির কাছ থেকেই সুমি শিখতে পারলেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আসল পরিচয়।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com