দেশের মোট ৩শ’ আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩৬৩টি, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টি। তিন মাসে বেড়েছে ১৬ হাজার ১৬টি মামলা। এদিকে মামলা বাড়লেও সে হারে বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে দেশের সব আদালতে এখন বিচারক এক হাজার ৯১৮ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৮১৯ জন অধস্তন আদালতে ও সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে মোট ৯৯ জন।
মামলা নিষ্পত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ হাতে নেয়া হলেও মামলাজট কমানো যাচ্ছে না। মামলার ভারে জর্জরিত আদালতে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। রায় যখন পাওয়া যায়, তখন আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। ফলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি জোরদার করা দরকার। সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন, অধস্তন থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত দেশের আদালতগুলোতে (৩১ মার্চ পর্যন্ত) মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টি। মন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের জন্য একটি আধুনিক বিচার বিভাগ ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে আসবে এবং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কার্যকর ও দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধিত হবে।
তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ৫৭১ জন সহকারী জজ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সারা দেশে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১২তম জুডিশিয়াল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সদ্য প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে মামলা ছিল ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টি। ৩০ জুন তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩৬৩টিতে। এর মধ্যে নিু আদালতে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ২৯৮টি, সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬২টি ও আপিল বিভাগে ২১ হাজার ৪১০টি মামলা বিচারাধীন। পরিসংখ্যানমতে, ঢাকার মোট ৪০টি আদালতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২১৮টি।
বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারপতি রয়েছেন ৯২ জন। এর মধ্যে বর্তমানে তিনজন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ৩৫টি দ্বৈত ও ১৯টি একক বেঞ্চে চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৩ মাসে বিভিন্ন শ্রেণির (ফৌজদারি, দেওয়ানি ও রিট) মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫ হাজার ২৩৮টি। আর আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৬১৩টি।
সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মো. সাইফুর রহমান বলেন, চলতি বছরের শুরুতেই প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের বেশ কয়েকটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন একেবারে পুরনো ফৌজদারি (বিবিধ) মামলাগুলোর শুনানির জন্য। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার পুরনো মামলাগুলো হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের কার্যতালিকায় (কজ লিস্ট) শুনানির জন্য রাখা হয়। পরে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করেন আদালত। তিনি বলেন, বর্তমানে সারা দেশে অধস্তন আদালতে ১ হাজার ৮১৯ জন বিচারক রয়েছেন।
সারা দেশে মামলাজট দীর্ঘদিনের। মামলাজট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও। ইতঃপূর্বে সুপ্রিম কোর্টের এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আমি অনেক ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। অধস্তন আদালতসমূহে মূল মামলার নিষ্পত্তি বৃদ্ধিকল্পে জামিন ও অন্তর্বর্তীকালীন বিষয়াবলি শুনানি দিবসের দ্বিতীয় ভাগে এবং মূল মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ দিবসের প্রথম ভাগে করার জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছি।
তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্ট থেকে এ বিষয়ে একটি সার্কুলার ইস্যু করা হয়েছে। এর ফলে মূল মামলার নিষ্পত্তি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুপ্রিমকোর্টকে সংবিধান ১০৯ অনুচ্ছেদে যে ক্ষমতা প্রদান করেছে তদবুনিয়াদে সুপ্রিমকোর্ট থেকে সব সময় মনিটর করা হচ্ছে যেন অধস্তন আদালতসমূহ তাদের কর্মঘণ্টার সবটাই বিচারিক কাজে ব্যবহার করে এবং অনর্থক যেন মামলার শুনানি মুলতবি না করে।
তিনি বলেন, মাত্র ১৭০০ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ জুডিশিয়ারির জন্য এটি একটি মাইলফলক অর্জন বলে আমি মনে করি। হাইকোর্ট বিভাগে প্রতি বৃহস্পতিবার ১৪টি বেঞ্চে মিস মামলা শুনানির জন্য আমি নির্দেশ দিয়েছি। এতে করে জমে থাকা মামলার পরিমাণ কমে যাবে এবং মূল মামলা নিষ্পত্তিতে অধিক সময় ব্যয় করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। মামলা ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা এমন আরও অনেক বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।
মামলাজট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বর্তমান অবস্থায় জট কমাতে হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা কমার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেমন: অনেক মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিচার শেষ না হওয়ার আগেই বিচারককে অন্যত্র বদলি করা হয়। এ ক্ষেত্রে নতুন বিচারক এসে মামলাটি বুঝতে সময় লাগে। অনেক মামলা আছে নতুন করে শুনানি করা হয়। এ ছাড়া মামলায় সাক্ষী না আসার কারণে অনেক সময় মামলা এগোতে পারে না। সময়মতো সাক্ষীকে উপস্থাপন না করায় বিচার সম্পন্ন হতে সময় লাগছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইলে বিচারক ও তাদের সহায়ক লোকবল বাড়াতে হবে, এর আগে ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার।
জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী আরও বলেন, আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লাগছে। রায় যখন মেলে, তখন প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না। শফিক আহমেদ বলেন, মামলাজট কমাতে হলে সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। সূত্র- যুগান্তর