প্রিয়াঙ্কা মজুমদার:
প্রায়ই বিশ্ব মিডিয়ার সংবাদ হয় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, ভেনেজুয়েলা, ইজরায়েল, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের মত দেশে সহিংসতা যখন মানবিক বিপর্যয়, সামরিক সংঘর্ষ, আঞ্চলিক সংঘাত, সংখ্যালঘু নির্যাতন, খুন, ধর্ষণসহ বিশ্বের জন্য উদ্বেগের বিষয় তখন পাশের দেশ ভুটান সম্পর্কে এমন কোন সংবাদ খুব একটা দেখা যায়না। স্বভাবতই কৌতূহল জাগে বৈকি সুখী মানুষের দেশে অপরাধ কেমন? কেমন সেই দেশের আইন, রাজনীতি ও বিচার ব্যবস্থা?
৩৮ হাজার ৩ শ ৯৪ বর্গকিলোমিটার ও ৮ লাখ ১৭ হাজার ৫৪ জন জনসংখ্যার এই দেশটি ২০০৮ সালে জাতীয় সুখের সূচক ঘোষণা করে সারা বিশ্বকে চমকে দেয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যখন জিডিপি [Gross Domestic Product (GDP)] এর ভিত্তিতে উন্নয়নের মাত্রা নির্ধারণ করে সেখানে ভুটান তাদের সাফল্য নির্ধারণ করে জিএনএইচ বা Gross National Happiness এর মাধ্যমে যার ভিত্তি হল, Equitable social development, Cultural preservation, Conservation of the environment এবং Good governance.
ভুটান বিশ্বাস করে High value, low impact ট্যুরিজমে। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের পর্যটকদের ভুটান ঘুরতে গেলে প্রতিদিন খরচ করতে হবে ২০০-২৫০ ডলার যা ব্যবহার করা হয় জনগণের ফ্রি চিকিৎসা, শিক্ষা, দারিদ্র্য ও পরিবেশ রক্ষায়। দেশটিতে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় বিনামূল্যে, এটি মৌলিক মানবাধিকারের অন্যতম। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ গ্রহণ করা দেশটি সেই কতিপয় দেশগুলোর মধ্যে একটি যেটি কোনকালেই পরাধীন ছিল না। ১৯৭২ সালে ক্ষমতায় আসা জিগমে সিঙিয়ে ওয়াংচাই হলেন জনগণের সামগ্রিক সুখের প্রবক্তা। তার সময়েই ভুটান গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
২০০৮ সালের ১৮ জুলাই ভুটানে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ভুটান সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিনত হয়৷এদিনই ভুটানের নতুন সংবিধান গ্রহণ করা হয় যা বুদ্ধিষ্ট দর্শন ও ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস এর উপর ভিত্তি করে গঠিত। এতে রয়েছে ৩৫টি আর্টিকেল ও ৪টি শিডিউল। ভুটানের সংবিধান দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের আদলে প্রণীত। সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন প্রিন্সেস সোনাম ওয়াংচুক। তিনি বলেন, মানবাধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষার কারনেই তারা দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধানে Fundamental rights এবং Fundamental principles of state policy এই দুই ভাগ দেখা গেলেও ভুটানের সংবিধানে Fundamental duty নামে আরেকটি ভাগ দেখা যায়। যেখানে মূলত রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। এই ভাগের আর্টিকেল ৮(৫) এ বলা হয়েছে, “A person shall not tolerate or participate in acts of injury, torture or killing of another person, terrorism, abuse of women, children or any other person and shall take necessary steps to prevent such acts. অর্থাৎ, “একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির আঘাত, নির্যাতন বা হত্যা, সন্ত্রাসবাদ, নারী, শিশু বা অন্য কোনও ব্যক্তির অপব্যবহার সহ্য বা অংশগ্রহণ সহ্য করবে না এবং এই ধরনের কাজ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে”। এগুলো ভুটানের নাগরিকদের মৌলিক দায়িত্ব যা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
ভুটানই বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা কার্বন উৎপাদন করে না। ফলে দেশটিতে যে পরিমাণ কার্বন নির্গত হয়, এর চেয়ে শোষণের মাত্রা অনেক বেশি। দেশের মোট ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ বনভূমি রাখা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। ভুটান সংবিধানে পরিবেশ বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট ভাগ রয়েছে। আর্টিকেল ৫ ধারা ৩ অনুযায়ী, “The Government shall ensure that, in order to conserve the country’s natural resources and to prevent degradation of the ecosystem, a minimum of sixty percent of Bhutan’s total land shall be maintained under forest cover for all time.” রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণকে পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর্টিকেল ৮(২) এ বলা হয়েছে, “A Bhutanese citizen shall have the duty to preserve, protect and respect the environment, culture and heritage of the nation.” ভুটানের সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক তাদের জাতীয় পোশাক ‘ঘো’ এবং ‘কীরা’ যা পরিধান অবশ্যকরণীয়।
ভুটান হল বিশ্বের সবচেয়ে কম দূর্ণীতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে একটি। দেশটিতে কদাচিৎ ছোটখাট অপরাধের খবর হয়, সহিংস ঘটনা প্রায় ঘটেনা বললেই চলে। সারা বছরে গড়ে ২১ টির মত খুনের ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পরেছে ৪৯২ ট্রাফিক অপরাধ এবং ১২৬ অপরাধী। ভুটান পুলিশের মতে এটা উদ্বেগজনক কেননা সাম্প্রতিক সময়ে ভুটানে অপরাধ বেড়েছে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি এর জন্য তারা টেলিভিশন কে দায়ী করেন। Phuntsho Rapten Of The Centre For Bhutan Studies লিখেছেন, “Crimes and corruption are often born out of economic desires.” তারা আরো মনে করেন, যুব সমাজের বেকারত্ব এবং অপরাধের মধ্যে একটা স্পষ্ট সম্বন্ধ রয়েছে। একটা রাষ্ট্র যখন বিপুল পরিমাণ চাকরি প্রত্যাশীদের চাহিদা মাফিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, হতাশ হয়ে যুবসমাজ অপরাধের দিকে ধাবিত হয় এমনটাই মনে করে ভুটান প্রশাসন। রয়্যাল ভুটান পুলিশ বলছে গত ৫ বছরে ২৪ এর কম বয়সী ৪৯৪২ তরুণ গ্রেফতার হয়েছে। যদিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী ভুটানের অবস্থান ২৫ তম তথাপি সাম্প্রতিক সময়ে যুব সমাজের অপরাধ প্রবণতা ভুটান সরকারকে ভাবাচ্ছে। দেশটির দণ্ডবিধিতে (The Bhutan Penal Code 2004) বিভিন্ন ধরনের অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তাদের দণ্ডবিধিতে রয়েছে ৩৫ টি অধ্যায় এবং ৫১৪ ধারা। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩ ধারায় অপরাধ কে Felony, Misdemeanor, Pettey misdemeanor, Violation ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। গুরুতর অপরাধ বা Felony আবার চার ধরনের যেমন,
- প্রথম ডিগ্রী: খুন, অপহরণ, সন্ত্রাসবাদের মত অপরাধ এই শ্রেণীতে পরে যার শাস্তি ১৫ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত।
- দ্বিতীয় ডিগ্রী: জালিয়াতি, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ ইত্যাদি এই শ্রেণীর অপরাধ যার শাস্তি ৯ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত।
- তৃতীয় ডিগ্রী: ডাকাতি, গণধর্ষণ, ১২ বছরের উর্ধ্বে কাউকে ধর্ষণের মত অপরাধ এই শ্রেণীতে পরে। এর শাস্তি ৫ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত।
- চতুর্থ ডিগ্রী: এই শ্রেণীর অপরাধ হল চুরি, মানহানি। ৩ থেকে ৫ বছর হল এই ধরনের অপরাধের শাস্তি।
এছাড়া, সাধারণ, তুচ্ছ ও বিভিন্ন ভায়োলেশনের জন্য অপরাধের ধরণ বুঝে ৩ বছর থেকে ১ মাসের মত শাস্তি এবং জরিমানা রয়েছে।
ভুটানে কাউকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় না। ২০০৪ সালের ২০ জুলাই মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং ২০০৮ সালের সংবিধান দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ভুটানের মানুষ ধর্ম, সংস্কৃতি এবং আইনের ব্যাপারে খুব সংবেদনশীল। সংবিধানের আর্টিকেল ৩(১) স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে দেশটি শান্তি, অহিংসা, মূল্যবোধ, সহানুভূতি ও সহনশীলতার প্রচার করে (Buddhism is the spiritual heritage of Bhutan, which promotes the principles and values of peace, non-violence, compassion and tolerance.)।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুখ খাতে টেকসই উন্নয়ন ও বিনিয়োগ দেশটির ভবিষ্যতকে ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল করছে। বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যাবে যুদ্ধ, সংঘাত আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বর্তমান বিশ্ব আর এমন অস্থির সময়ে ভুটান স্বমহিমায় সুখী মানুষের দেশ হিসেবে এগিয়ে চলেছে। দেশটির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
লেখক : আইনজীবী, ফেনী জজ কোর্ট।