আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী:
বাংলাদেশের এক কবি লিখেছিলেন, ‘নদী শুধু নারী নয়, পুরুষের মতো আছে নদ। মানুষের মতো সেও হাসে-কাঁদে, ভাঙে-গড়ে, আছে তার ক্রোধ।’ এই সত্যটা প্রাচীনকাল থেকে উপমহাদেশের সমাজ-সংস্কৃতিতে স্বীকৃত। কেবল তার কোনো আইনি স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। মানুষের চেয়েও নদনদীকে বেশি সম্মান দিয়েছে উপমহাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ।
সেই আদিকাল থেকে তারা গঙ্গা নদীকে দেবী জ্ঞানে পূজা করে। বিশ্বাস করে, গঙ্গা স্নানে সব পাপ মোচন হয়। লাখ লাখ মানুষ এখনও প্রতি বছর গঙ্গা স্নানে যায়। বিশ্বাস করে, গঙ্গা স্নানে তারা পাপমুক্ত হলো। গঙ্গাকে শুধু দেবত্ব নয়, মায়ের সম্মানও প্রদর্শন করে। কিন্তু উপমহাদেশে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এসব নদনদী দেবতা হিসেবে পূজিত হলেও কখনও তাদের সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা হয়নি।
সম্প্রতি ভারতের কাগজেই খবর বেরিয়েছে, বিভিন্ন পুণ্যস্থান দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর পানি এত দূষিত হয়েছে যে, এই নদীতে স্নান করা, নদীর পানি পান করা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। যে কোনো সময় রোগ-পীড়া-মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। নদীর অবস্থাও ভালো নয়। কোথাও চর পড়ে নদী শুকিয়ে গেছে। নাব্য কমে গেছে। মানুষ নদীতে মলমূত্র, আবর্জনা ফেলে পানি দূষিত করে ফেলেছে।
বাংলাদেশে তো আবার নদনদীর বড় শত্রু মানুষই। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে নদী খনন, নদী সংস্কার না হওয়ায় তার গভীরতা ও নাব্য শঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তার ওপর অসাধু মানুষ নদীতে বালু ফেলে নদী মজিয়ে দিয়ে বসতি স্থাপন ও দোকানপাট করার জন্য অবৈধভাবে তার দখল নিচ্ছে।
এই সমস্যাটি রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা এবং বন্দরনগর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর জন্যও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই অসৎ ও অসাধু কাজের সঙ্গে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের যোগাযোগ এত প্রবল যে, নদী রক্ষার জন্য আইন হয়; সেই আইন কার্যকর হয় না। ফলে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আবহাওয়া প্রতিকূল হয়ে উঠছে, প্রাণিসম্পদ রক্ষা করা দুরূহ হচ্ছে। এই পরিবেশ দূষণ এবং নদী, পানি ও বনসম্পদ রক্ষায় বিশ্বময় জোরালো আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বময় এই পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের একজন অগ্রনায়ক। কিন্তু পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন এ ব্যাপারে বিপজ্জনকভাবে উদাসীন।
বাংলাদেশে নদনদী, বনসম্পদ রক্ষা (সুন্দরবন রক্ষাসহ) ও পরিবেশ দূষণ বন্ধ করার জন্য বহুদিন ধরে আন্দোলন চলছে। গত ৩০ জুন দেশের হাইকোর্টের রায়ে দেশবাসীর এই দাবি পূরিত হতে চলেছে মনে হয়। নদনদী রক্ষা সম্পর্কে এক ব্যক্তির করা রিট সম্পর্কে রায় দিতে গিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তুরাগ নদকে লিগ্যাল পারসন বা ‘জীবিত ব্যক্তি’ বলে ঘোষণা করেন। ১ জুলাই পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ হলে দেখা যায়, কেবল তুরাগ নদ নয়, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সব নদীকে একই মর্যাদা দিয়ে লিগ্যাল পারসন বা আইনি ব্যক্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। হাসিনা সরকারের আমলে এই রায়টি ঘোষিত হওয়ায় পরিবেশ দূষণ থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা এবং নদনদী, বনাঞ্চল রক্ষায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে শেখ হাসিনার যে ভূমিকা, তার আন্তরিকতা প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশে নদনদী ও বনরক্ষায় আন্দোলন চলছিল বহুদিন ধরে। একজন নাগরিকের নামে দায়ের করা আবেদনের ফলে প্রথমে একটি নদীকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমানে সব নদীকেই এই মর্যাদা দেওয়া হলো। এই মর্যাদা দান বাস্তবে কার্যকর হলে দেশের নদনদী, বনসম্পদ শুধু রক্ষা পাবে না, বনের প্রাণিসম্পদ রক্ষা পাবে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণমুক্ত করার সুযোগ বিস্তৃত হবে।
এর আগে নিউজিল্যান্ড, কলম্বিয়া ও ভারতে কিছু নদীকে মানব সত্তার মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া হয়। নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাউরি সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, তাদের উৎপত্তি হোয়াঙ্গানুই নদী থেকে। সুতরাং তাদের দাবি ছিল, এই নদীর জীবন্ত মাতৃসত্তাকে আইনি স্বীকৃতিদানের। ১৪০ বছর ধরে তারা এই আন্দোলন চালায়। ২০১৭ সালে তাদের দাবিটি পূরিত হয় এবং আইন সভায় একে আইন হিসেবে পাস করা হয়।
কলম্বিয়ায় আরও আগেই দেশটির আত্রাতো নদীর সুরক্ষা, সংরক্ষণ, খনন ও সংস্কার কার্য বাধ্যতামূলক করা হয়। ভারতের একটি হাইকোর্ট গঙ্গা ও যমুনা নদীকে আইনি ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা দেন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। নিউজিল্যান্ডের মাউরি সম্প্রদায় যেমন মনে করে, হোয়াঙ্গানুই নদীটি তাদের জন্মদাত্রী, তেমনি উপমহাদেশের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, হিমালয় পর্বত থেকে নেমে আসা গঙ্গা নদী তাদের জন্মদাত্রী।
এই বিশ্বাস থেকে গঙ্গাকে তারা ডাকেন মা গঙ্গা। নদীটিকে তারা পূজা দেন। গঙ্গা স্নানে পুণ্য অর্জিত হয় বলে বিশ্বাস পোষণ করেন। আজ বাংলাদেশে সব নদনদীকে জীবন্ত সত্তা বলে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হলো। কিন্তু বাংলাদেশের ধর্ম, মত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছেই নদী জীবন্ত এবং নদীর রাগ, ক্রোধ, প্রসন্নতা আছে বলে বহুযুগ থেকে তাদের বিশ্বাসের অঙ্গ। আমি নদীমাতৃক বরিশালের মানুষ। নদীর প্রমত্তা ও প্রসন্ন রূপ দুই-ই আমি দেখেছি। এককালে বরিশালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ, বিষখালী, আগুনমুখা প্রভৃতি নদীর প্রমত্তা
ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছি। আবার কীর্তনখোলা, ইলশা, সুগন্ধী প্রভৃতি নদীর প্রসন্ন রূপও দর্শন করেছি। কালাবদর নদীটি এখন শুকিয়ে গেছে। এককালে এই নদী পাড়ি দেওয়ার আগে মানুষ নদীকে উৎসর্গ করে গরু ও মহিষ বলি দিত। নদীকে জীবন্ত না ভাবলে এসব কেউ করত না।
বাংলাদেশে পদ্মা ও মেঘনা নদীর ভাঙন এককালে ছিল ভয়ঙ্কর, এখনও আছে। বহু জনপদ পদ্মা ও মেঘনা গ্রাস করেছে। এ জন্য পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা। বর্তমানে দেশের কোথাও কোথাও সংরক্ষণ ও সংরক্ষণের অভাবে মেঘনা ও পদ্মার মতো নদীও শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষের জীবনে নানা দুর্দৈব দেখা দিচ্ছে। গঙ্গা ও তিস্তার পানিকে বলা হয় বাংলাদেশের মানুষের জীবনপ্রবাহ। এই দুই নদীতে ভারত বাঁধ নির্মাণ করার ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। চাষাবাদের ক্ষতি হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নদীর পানি নিয়ে সমস্যা রয়েছে। গঙ্গার পানি বণ্টনের একটা ব্যবস্থা হলেও তিস্তা সমস্যা এখনও রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই ভাগ্য নির্ধারণকারী। নদীর স্বাস্থ্য ভালো থাকলে চাষাবাদ ভালো হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হয়। নদী বিমুখ হলে জলাভাব, খরা, চাষবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দার ফলে দেশের ক্ষতি হয়। সে জন্য পানামা, সুয়েজ, শাতিল আরব নিয়ে এত যুদ্ধ। গঙ্গা, সিন্ধু, তিস্তার পানি নিয়ে এত বিরোধ। এই বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ভবিষ্যতে যদি আরেকটি মহাযুদ্ধ হয়, তাহলে তা হবে পানি নিয়ে। গ্যাস বা পেট্রোল সম্পদ নিয়ে নয়।
বাংলাদেশে নদী সংরক্ষণের আইন হলো। বনসম্পদ রক্ষায়ও আইন হওয়া দরকার। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু আবিস্কার করে গেছেন, গাছেরও প্রাণ আছে। তাই নদীর মতো বৃক্ষ সংরক্ষণেরও আইনি ব্যবস্থা হওয়া দরকার। দেশের আদালত নদীর জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই মর্যাদা রক্ষায় বিধিনির্দেশও দিয়েছেন। সরকারের উচিত হবে, এই বিধিনিষেধ কঠোরভাবে কার্যকর করা। দেশের এক শ্রেণির প্রভাবশালী অসাধু মানুষই নদী ও বনসম্পদের ক্ষতি করছে। নদী ভরিয়ে ফেলে তাতে তাদের অবৈধ দখল প্রতিষ্ঠা করছে। গাছ কাটছে। পাহাড় কেটে ফেলছে। দেশের এই ভয়ঙ্কর ক্ষতি করা দেশদ্রোহের শামিল। এই অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থার সঙ্গে নদী, বন ও পাহাড়গুলো সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করা দরকার। নইলে কেবল আইন করে দেশকে রক্ষা করা যাবে না।
লেখক : গ্রন্থকার ও কলামিস্ট