মাথা থাকলে ব্যথা থাকবে, তেমনি জমি থাকলে তার চিন্তা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জমির ব্যাপারে কেউ কোন ছাড় দিতে চান না। তাই যখন জমির মালিকের কাছে নোটিশ আসে তার জমি দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিগ্রহণ করতে হবে, তখন জমির মালিকের মাথায় হাত! অনেকের আবার অধিগ্রহণ বিষয়ক জ্ঞান না থাকায় নানা রকম দুশ্চিন্তা ও ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটা জরুরী। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট রীনা পারভিন মিমি
- ভূমি অধিগ্রহণ
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক ভূমি অধিগ্রহণ বলতে আসলে কি বুঝায়। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর ধারা (১) অনুযায়ী ‘অধিগ্রহণ’ অর্থ ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন বা উভয়ের বিনিময়ে প্রত্যাশী ব্যক্তি বা সংস্থার জন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তির স্বত্ব ও দখল গ্রহণ।
- ভূমি অধিগ্রহণ কেন করা হয়?
দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রচলিত অধিগ্রহণ আইন অনুসারে ব্যক্তি মালিকানাধীন বা দখলাধীন ভূমি অধিগ্রহণ করে থাকে। এখন প্রশ্ন হল সরকার চাইলেই কি যেকোনো সময় যে কারো ভূমি অধিগ্রহণ করতে পারে? উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, পারে। জনস্বার্থে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেলপথ, সড়ক বা সেতুর প্রবেশ পথ বা এ জাতীয় অন্যকিছুর জন্য জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন পড়লে সরকার দেশের যেকোনো জেলায় যে কারো জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। তবে নতুন আইন স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর ধারা (১৩) অনুসারে ধর্মীয় উপাসনালয়, কবরস্থান ও শ্মশান অধিগ্রহণ করা যাবে না। তবে শর্ত আছে যে এগুলো অধিগ্রহণ করা যবে যদি তা জনপ্রয়োজনে বা জনস্বার্থে একান্ত অপরিহার্য হয়। সেক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ব্যক্তি বা সংস্থার অর্থে স্থানান্তর ও পুনঃনির্মাণ করে দিতে হবে।
- ভূমি অধিগ্রহণ হলে করণীয় কি?
রাষ্ট্র তার দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করবে তাই বলে ভূমির মালিকের এখানে করণীয় কিছুই নেই সেটা বলা যবে না। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর ধারা (৫) অনুযায়ী ৪ ধারার নোটিশ জারির পর ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ পনের (১৫) কার্য দিবসের মধ্যে অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের (Divisional Commissioner) নিকট আপত্তি দাখিল করতে পারবেন। আপত্তি পাওয়ার পর Divisional Commissioner সম্পত্তির পরিমাণ ৫০ বিঘার (১৬.৫০) একরের ঊর্ধ্বে হলে তার মতামত সংবলিত প্রতিবেদনসহ নথি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জন্য প্রেরণ করবেন। আর জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার কম হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি র মতামত সংবলিত প্রতিবেদনসহ নথি কমিশনারের কাছে প্রেরণ করবেন।
সরকার বা কমিশনার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত জনপ্রয়োজন বা জনস্বার্থে গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, এর বিরুদ্ধে কোথাও আপীল করা যাবে না। সবশেষে দেখা যাচ্ছে যে, ৩ এবং ৪ ধারার নোটিশ জারি করার পরই কেবল শেষবারের মতো ৭ ধারায় নোটিশ জারি করা হয়। ৭ ধারায় নোটিশ জারির পর আর কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না।
- ভূমি অধিগ্রহনের ফলে ক্ষতিপূরণ আদায়
সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করবে সমস্যা নেই কিন্তু মূল সমস্যাটা হলো ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে। কেননা অনেকেই জানেন না ক্ষতিপূরণের টাকা কীভাবে আদায় করতে হয় বা। জমি অধিগ্রহনের পড়ে ক্ষতিপূরণের টাকার নোটিশ যায় ডিসি অফিসের রেকর্ড বই অনুযায়ী। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর ধারা ৯ অনুযায়ী সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে ওই এলাকার জমির ১২ মাসের গড় মূল্যের সাথে আরও অতিরিক্ত ২০০ ভাগ ক্ষতিপূরণ পাবেন জমির মালিক। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জমির গড় মূল্যের ৩০০ ভাগ। অর্থাৎ সরকার নিজের প্রয়োজনে ৫০০ টাকার মূল্যের জমি অধিগ্রহণ করলে জমির মালিক পাবে ১৫০০ টাকা (৩ গুণ), বেসরকারি (চার গুণ)।
যখন ৭ ধারায় নোটিশ জারি করা হয় তখন ভূমির মালিক জেলা প্রশাসক। ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য যেসব প্রমাণাদি প্রয়োজন হয়। স্থানীয় চেয়ারম্যান কর্তৃক সত্যায়িত ছবি, নাগরিকত্ব সনদ,খতিয়ান মূল/সার্টিফাইড কপি,হাল সনের খাজনা দাখিল, ওয়ারিশ সনদপত্র, রোয়েদাদনামা, ক্ষমতাপত্র (নাদাবিপত্র), বণ্টননামা, হস্তান্তরিত সকল দলিল, ধারা ৭ এর নোটিশে উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের প্রমাণাদি।
উপরোক্ত সকল কাগজপত্রসহ একটি ফাইল প্রস্তুত করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় বা LA শাখায় জমা দিতে হবে। ফাইলটি জমা হবার পর সেখানকার রেজিস্টার বুকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণকারীর নাম, খতিয়ান নম্বর, ৮ ধারা নোটিশের রোয়েদাদ এবং জমির পরিমাণ লিখে একটি নাম্বার পরবে। এই সিরিয়াল নাম্বার অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
- রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি নিয়ে মামলা করা যাবে কি-না?
অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি নিয়ে পদত্ত কোন আদেশ বা গ্ররহিত কোন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন ধরণের মামলা বা আবেদন গ্রহণ করার এখতিয়ার রহিত করা হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখন আইন, ২০১৭ এর (৪৭) ধারায় অধিগ্রহণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা না করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এরপরও ৮ ধারায় নোটিশ জারির পরেও অসাধু চক্রের যোগসাজশে Tittle Suit দায়ের করছে। এতে করে ভূমির মালিকগণ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছে। সংবিধানের ৪২(২) অনুচ্ছেদেও ক্ষতিপূরণসহ বাধ্যতামূলকভাবে স্থাবর সম্পত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা না করার বিষয়ে বলা হয়েছে। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ সম্পর্কিত ভূমি নিয়ে কোন প্রকার মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা নিয়ে পরিপত্র জারি করেছে। তবে সার্ভেয়ার ও কানুনগোর প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জমির মালিকানা কেন্দ্রিক বা অন্য কোন ধরণের জটিলতা থাকলে ADC রিভিনিউ বরাবর মিস কেসের মাধ্যমে তা সমাধান করা যায়। মিস কেসের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে যেকোনো আরবিট্রেশন সমাধান করার নিয়ম আছে। অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য দণ্ডবিধি ১৮৬০ (ধারা ১৭৫ ও ১৭৬) অনুযায়ী।
- অধিগ্রহণ সম্পত্তি পুনঃগ্রহণ
স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও সম্পত্তি হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর ১৯ (১) ও (২) ধারা মোতাবেক প্রত্যাশী সংস্থার অনুকূলে অধিগৃহীত সম্পত্তি যে উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে বা বিক্রয়,লিজ, এওয়াজ বা অন্যকোনোভাবে হস্তান্তর করা হলে অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি জেলা প্রশাসক কর্তৃক পুনঃগ্রহণ করে সরকারি দাগ খতিয়ানে আনয়ন পূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন। এখানে ভূমির মালিক যদি কোন ক্ষতিপূরণ না নেন তবে তার একধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।
বর্তমান আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারা। এটি প্রায়শই এমন দেখা যায় যে উদ্দেশ্যে কোনো জমি হুকুমদখল করা হয় তা অন্য উদ্দেশ্যে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সরকারি পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহত হচ্ছে আবার কখনো কখনো এটাও লক্ষ্য করা যতটুকু ভূমি হুকুমদখল প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি জমি হুকুমদখল করান এবং তা দীর্ঘদীন ফেলে রাখেন এতে ভূমির মতন বিরল সম্পদের উপর চাপ পড়ে।
বর্তমানে কার্যকর ভূমি আইনটি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির মালিকদের মনে একটু স্বস্তি ফিরিয়ে আনলেও ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অনিয়ম-দুর্নীতি এবং আইনগত বেশ ফাঁক-ফোকড়ের ফলে জমির মালিকগণ সঠিক উপায়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারছেন না। জমি অধিগ্রহণ হলে এমনিতেই জমির মালিক হতাশায় ভোগেন তার উপর যখন এসব হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়, তার তখন আর্তনাদ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এমনও অনেকে আছেন যার শেষ সম্বল ওইটুকু জমি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি তাই ক্ষতিপূরণ যথাসম্ভব দ্রুত প্রদান করে তাদের পুনর্বাসন করা উচিৎ।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল একটি দেশ তাই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে আর এসকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হলে অধিগ্রহনের প্রয়োজন বা প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত, দিচ্ছে বা ভবিষ্যতেও দিবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখার গুরুতর সমস্যা সমাধান করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি হয়রানি কমানোর বন্দোবস্ত করতে হবে। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসিত হচ্ছে কি-না লক্ষ্য রাখতে হবে। সবশেষে ভূমি মালিকদের উদ্দেশ্যে বলা, ভূমি/জমির মালিক হয়ে জমির সংক্রান্ত কাগজপত্র সিন্দুকে না রেখে এগুলর সর্বশেষ খতিয়ান অনুযায়ী নামজারি ও খাজনা প্রদান করুন। তাহলে এসকল সমস্যা শুধু নয় জমির আরো অনেক সমস্যা থেকে অনেকটা রেহাই পাবেন।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম। ইমেল- rinaparvinmimi18@gmail.com