সালেক খোকন:
লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী কর্ণফুলী। তারই শাখা নদী তুইচং। পাহাড়িদের কাছে এ নদীটি পবিত্রতম স্থান। কেন? তা নিয়ে প্রচলিত আছে একটি লোককাহিনী। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় সে কাহিনী দিয়েই শুরু করছি। কোনো এককালের কথা। পাহাড়ের পাশে ছিল ছোট্ট এক গ্রাম। সে গ্রামেই বাস করত দুই বোন। নাম- তুইচংগী ও নোয়েংগী। তুইচংগী বড়। নোয়েংগী ছোট। দুজনে বেজায় ভাব। একবার ঘটল এক ঘটনা। জুমচাষের সময় তখন। পাহাড়ের গহিন অরণ্যে গিয়ে দুই বোন জংলাগাছ কেটে জুমের জমি তৈরি করতে থাকে। চৈত্র মাস। প্রচণ্ড গরম। কাজ করতে করতে ছোট বোনের প্রচণ্ড পিপাসা পায়। কিন্তু আশপাশের কোথাও জল নেই। জলের অভাবে গলা শুকিয়ে যায় তার। একসময় সে জ্ঞানও হারায়। ছোট বোনের এ হাল দেখে বড় বোন তুইচংগী ছটফট করে। জলের খোঁজে গহিন অরণ্যের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে। কিন্তু কোথাও জল পায় না। তাহলে কি বাঁচবে না তার আদরের বোনটি? বোনের পাশে বসে বড় বোন কাঁদতে থাকেন। এমন সময় স্বর্গ থেকে নেমে আসে এক বৃদ্ধ। তিনি বড় বোনের কান্না থামালেন। অতঃপর কানে কানে একটি মন্ত্র শিখিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেলেন। বড় বোনের মুখে তখন হাসি। মন্ত্রবলে সে নদী হয়ে যায়। সে নদীর জল পান করে জীবন ফিরে পায় তার ছোট বোন। কিন্তু বড় বোন আর মানুষরূপে ফিরতে পারে না। কারণ মন্ত্রের শর্তই ছিল তেমন। বোনের জীবন বাঁচাতে এভাবেই বড় বোন নিজেকে উৎসর্গ করেন নদীরূপে। সে থেকেই এ নদী পাহাড়িদের কাছে পবিত্রতম স্থান। প্রচলিত এ ধরনের বিশ্বাসের কারণে গোমতী নদীও চাকমাদের কাছে শ্রদ্ধার স্থান। শুধু পাহাড়েই নয়, নদীমাতৃক বাংলাদেশের বহু নদী নিয়ে এমন রূপকথা ও বিশ্বাসের গদ্যের সন্ধান মিলে লোকসাহিত্যে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে নদী। কিন্তু যুগে যুগে দুই পাড়ের জনজীবনকে প্রভাবিত করে আসা উপকারী নদীগুলোকে কি আমরা বাঁচাতে পেরেছি?
সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জানিয়েছে, বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৬টির মতো। যার একটিও দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। গণমাধ্যমকে দেওয়া বক্তব্যে তারা বলছেন, নদীর জায়গা দখল করে আবাসন প্রকল্প ও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি দোকানপাট ও বাজার হয়েছে। ঘরবাড়ি করে স্থানীয়রাও নদী-খালের জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। ফলে নদীদূষণসহ অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় মূল নদীর প্রবাহ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এভাবেই হত্যা করা হচ্ছে দেশের নদীগুলোকে। চলতি বছরের পহেলা জুলাইয়ের কথা। নদীর দূষণ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। বাংলাদেশের মধ্যে এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সব নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা দেয় আদালত। এর আগে পাশের দেশ ভারতেও নদীকে ‘জুরিসটিক পারসন’, ‘লিগ্যাল পারসন’ বা সর্বোপরি জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে ‘মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতির টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্য সংকট ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সংকটে পড়তে বাধ্য। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সরকার আইনপ্রণয়ন করে নদীকে বেদখলের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। নদী রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে জাগরণ শুরু হয়েছে। এখন সবারই ভাবনা পরিবেশের জন্য নদী রক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশের সব নদীকে রক্ষা করার সময় এসেছে। যদি তা না করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ নদী নিয়ে এ রায়টি যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী। কেউ যাতে নদী দখল করতে না পারে, নদীর প্রবাহ যেন ঠিক থাকে, সর্বোপরি নদী যাতে জীবন্ত থাকতে পারে, ভবিষ্যতে আর কেউ যেন নদী দখলের মতো সাহস না দেখায়, তা নিশ্চিত করতেই দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আদালত একটি বার্তা দেয় এই রায়ে। আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই সম্প্রতি সরকারের চিহ্নিত করা নদী দখলকারদের জেলাওয়ারি একটি বড় তালিকা প্রকাশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। নদী রক্ষা কার্যক্রমে যা কার্যকর উদ্যোগ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারা দখলের মাধ্যমে হত্যা করছেন নদীগুলোকে? কমিশনের তালিকা বলছে নদী দখলকারীদের মধ্যে ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়াও রয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদরা। সারা দেশে নদী দখলকারীদের সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার। সেখানে ৬২ জেলায় দখলকারী হিসেবে ৪৬ হাজার ৮৩৯টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম রয়েছে। শুধু ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় নদীর জমি অবৈধভাবে দখল করেছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৯। আর ২ হাজার ১৮৭ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, বাকলিয়া ও চাক্তাই খালের বিভিন্ন অংশ দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে। এভাবে তালিকায় নোয়াখালীতে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৮৩ জন আর সবচেয়ে কম ১৪ জন দখলকারীর নাম রয়েছে লালমনিরহাট জেলায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী রক্ষা কমিশনের এ তালিকা ‘সিএস’ ও ‘আরএস’ রেকর্ড অনুসারে প্রণয়ন করলে দখলদারীদের সংখ্যা আরও বাড়বে।
দেশের সব নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে নদী রক্ষা কমিশনকে ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালত রায়ে আরও বলেছে ‘দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদকে নিজ নিজ এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে ও পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীরা ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন। ঋণ দেওয়ার সময় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার যথাযথ ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় বা স্থানীয় কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। হাইকোর্টের এই রায়ের আলোকে সারা দেশের নদী দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়েও নদী দখলকারীর তালিকা প্রকাশ ও দখলকারীদের থেকে নদীকে মুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার কোনো নজিরও দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সময় বেঁধে দিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে জোরালো নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
নদী দখলের শাস্তি কী? জানা যায়, নদীর পরিবেশ কেউ ধ্বংস করলে আইন অনুযায়ী তাকে দুই বছর পর্যন্ত জেল দেওয়া যায়। আবার নদীতীরের কারখানা নিয়ম ভেঙে বর্জ্য ফেললে জরিমানা হয় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। নদী দখল ও দূষণের প্রভাবের তুলনায় এসব শাস্তি একেবারেই লঘু। সিআরপিসির ১৩৩ ধারায় ‘পাবলিক নুইসেন্স’ হিসেবে দখলকারীর শাস্তি হয় মাত্র পাঁচ দিনের জেল। এ কারণেই নদী দখলকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেছে আদালত। সেটি করতে পারলেই দেশের নদ-নদীগুলো মানুষের মতোই পাবে আইনি অধিকার। এতে রক্ষা পাবে নদীর-জীবন্ত সত্তা। কিন্তু সেই আইন সংশোধন করার উদ্যোগের খবর আমরা এখনো পাইনি। নদীরক্ষা আইনের বাস্তবিক প্রয়োগ ত্বরান্বিত করতে হবে। সব উন্নয়ন হোক নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে। নদীগুলো তার জীবন্ত সত্তা ফিরে পাক। নদী রক্ষায় রাষ্ট্রের জিরো টলারেন্স চাই। নদী বেঁচে থাকুক আমাদের জীবনপ্রবাহ ও সংস্কৃতির আলিঙ্গনে।
লেখক : লেখক ও গবেষক; contact@salekkhokon.net