মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কোনো ভাতা নিলে বা কাউকে ভাতা নিতে সহযোগিতা করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে এক ব্যক্তি একাধিক ভাতা নিলেও শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এমন বিধান রেখে ‘সামাজিক নিরাপত্তা আইন, ২০১৯’ এর খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্লিষ্টদের মতামতসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খসড়াটি চূড়ান্ত করার কাজ করছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫০টির মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মহিলা ও শিশু বিষয়ক, সমাজকল্যাণ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বড় বড় কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, দুঃস্থ নারী, চা বাগানের শ্রমিক, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারী, তৃতীয় লিঙ্গসহ পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভাতা দিচ্ছে সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সুশাসন জোরদার, কার্যকর সমন্বয়, সামাজিক বীমা ও পেনশন সুবিধা দিতে সুনির্দিষ্ট আইনি ভিত্তি সুসংগঠিত করা প্রয়োজন। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের সেবা প্রদান পদ্ধতি সহজীকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, জবাবদিহিতা জোরদার, নির্বাচনে দক্ষতা বৃদ্ধি করাও প্রয়োজনীয় বিষয়। এ সংক্রান্ত দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও স্বার্থের সংঘাত সংশ্লিষ্ট অপরাধের শাস্তি নিশ্চিতেও কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব কারণে সামাজিক নিরাপত্তা আইনটি করা হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (সিভিল রেজিস্ট্রেশন ও সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখা) শাহনাজ আরেফিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা একটা খসড়া (সামাজিক নিরাপত্তা আইন) করেছি, চট করেই তো একটা আইন করা যায় না। সবার মতামত নিচ্ছি। এছাড়া আইনের যে গ্রামার আছে সেগুলো ঠিক আছে কি-না, তা একটি কমিটি দেখছে। আমরা ছোট ছোট করে এগোচ্ছি। যাতে আইনটি করতে গিয়ে কোনো ভুল না করি।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিষয়ে আমাদের স্ট্র্যাটেজি আছে, অ্যাকশন প্ল্যান আছে। কোনো আইন নেই। স্ট্র্যাটেজি, অ্যাকশন প্ল্যান- এগুলো হচ্ছে সময়ভিত্তিক। আর আইন হচ্ছে স্থায়ী একটি ব্যবস্থা। যাতে সামাজিক নিরাপত্তার ভালো কাজগুলো কন্টিনিউ করা যায়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সব দেশেই আছে। এটা করতে যাতে আমার পেছনে ফিরে তাকাতে না হয়, এ আইনের হাত ধরে যাতে আমরা এগিয়ে যেতে পারি, এসব উদ্দেশ্যেই আইনটি করা হচ্ছে।’
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুবিধা নেন, অন্য কোনো ব্যক্তিকে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে ভাতা বা সুবিধা পেতে সহযোগিতা করেন, অন্যায়ভাবে কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা বা ভাতাপ্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বা সুবিধাপ্রাপ্তিতে সহযোগিতার জন্য উৎকোচ গ্রহণ বা দাবি করেন তবে তিনি অপরাধী হবেন।’
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগ/দফতর/সংস্থার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে গাফিলতি বা পরিষদকে (আইনের অধীনে গঠিত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা পরিষদ) সহযোগিতা না করেন বা অবহেলা প্রদর্শনের কোনো কাজ করেন তবে তিনিও এ আইনের আওতায় অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবে।
এসব অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে আরও বলা হয়েছে, দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন ও তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হবে।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগ, সংস্থা ও বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টারের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন এবং সর্বোপরি এ ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিতে ‘সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠিত হবে। সংক্ষেপে এটি সিএমসি বলে অভিহিত হবে। এ কমিটির সভাপতি হবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
মন্ত্রণালয়/বিভাগের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংক্রান্ত কার্যক্রম সমন্বয়ে সহযোগিতা এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় যোগাযোগ রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটিভুক্ত প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগের কমপক্ষে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা সামাজিক নিরাপত্তা ফোকাল পয়েন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত বা যুগ্ম সচিব (সমন্বয়) সামাজিক নিরাপত্তা ফোকাল পয়েন্ট হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন।
সামাজিক নিরাপত্তা ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তাদের কার্যক্রম সমন্বয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের (সমন্বয় ও সংস্কার) নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সামাজিক নিরাপত্তা ফোকাল পয়েন্ট সমন্বয় কমিটি গঠিত হবে। এ কমিটি সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির যাবতীয় কার্যক্রমে সহযোগিতা দেবে। কমিটি প্রতি তিন মাসে অন্তত একটি সভা করে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন সুপারিশ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে উপস্থাপন করবে।
মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টার
দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিতে কার্যক্রমের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোর সমন্বয়ে পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টার গঠন করা হবে। সামাজিক ভাতা ক্লাস্টার, খাদ্যনিরাপত্তা ও দুর্যোগ সহায়তা ক্লাস্টার, সামাজিক বীমা ক্লাস্টার, শ্রম ও জীবিকায়ন ক্লাস্টার এবং মানব উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন ক্লাস্টার। খসড়া আইনে এ পাঁচ ক্লাস্টারে অন্তর্ভুক্ত মন্ত্রণালয় ও কর্মসূচির বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম সমন্বয়, কর্মসূচির বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিবীক্ষণ, সুবিধাভোগীদের সিঙ্গেল রেজিস্ট্রি ও এমআইএস উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জেলা পর্যায়ে সার্বিক সুশাসন নিশ্চিতে প্রতিটি বিভাগে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ‘সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভাগীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠন করা হবে।
এছাড়া জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ‘সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত জেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি’ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ‘সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত উপজেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠন করা হবে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের সঙ্গে এনজিও ও সুশীল সমাজের কার্যকর সমন্বয় ও সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের (সমন্বয় ও সংস্কার) নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হবে।
‘একজন ব্যক্তি শুধু একটি সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন’ উল্লেখ করে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, ‘কোন অবস্থাতেই কেউ একাধিক সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন না।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাপ্রাপ্তির যোগ্যতা ও অযোগ্যতার শর্তাবলি প্রতিটি কার্যক্রমের সঙ্গে স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির যোগ্যতা সংক্রান্ত নীতিমালা পর্যালোচনা করে তা হালনাগাদ করার জন্য নির্দেশনা দেবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জনগণের দারিদ্র্য স্কোরভিত্তিক খানাজরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় কমিটির সুবিধাভোগী নির্বাচন করতে হবে। দারিদ্র্য স্কোর সংক্রান্ত কোনো আপিল বা অভিযোগ থাকলে তা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় এনজিওর সহায়তায় উপজেলা কমিটি যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সুবিধাভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলির নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও ভাতা বিতরণে ডিজিটাল তথা উদ্ভাবনী পদ্ধতি উৎসাহিত করবে।
উপযুক্ত ব্যক্তিরা ভাতা পেতে আবেদন করতে পারবেন
সামাজিক নিরাপত্তাপ্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিরা আবেদন করতে পারবেন। আবেদন যথাশিগগিরই যাচাই ও পর্যালোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আবেদনকারীকে ফলাফল জানাতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তায় সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় কমিটির কাছে আবেদন করতে পারবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে অভিযোগ বা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করতে পারবে।
তহবিল গঠন
সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় বিধায় আকস্মিক দুর্যোগকালীন ভাতা বিতরণের জন্য উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্থানীয় তহবিল গঠন করা যাবে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এ তহবিল থেকে যেকোনো দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য দেয়া যাবে।
চালু হবে সামাজিক নিরাপত্তা পদক
খসড়া আইনে বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার উদ্ভাবনী কার্যক্রম ও বিশেষ আর্থিক অনুদান উৎসাহিত করতে সরকার প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তা পদকসহ অন্যান্য পুরস্কার দিতে পারবে।
পরিষদ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা পদক এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য পুরস্কারগ্রহীতা নির্বাচন করবে।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের আলোকে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা পদক ও অন্যান্য পুরস্কারপ্রাপ্তির শর্তাবলি সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশিকা প্রণয়ন করবে বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। জাগো নিউজ