অ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম (জে-ইসলাম):
যারা আইন পড়ার ব্যাপারে ভাবছেন বা যারা সবেমাত্র আইন পড়া শুরু করেছেন লেখাটি বিশেষত তাদের জন্য। এছাড়াও এলএলবি অনার্স কোর্স ও এলএলবি পাস কোর্স নিয়ে যাদের মনে অহেতুক নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে তাদের জন্য এই লেখা।
🌎 এলএলবি অনার্স নাকি এলএলবি পাস কোর্সের কার্যকারিতা বেশী?
উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর ও ব্যাখ্যা নিয়ে আইন শিক্ষার্থীদেরকে দুটি ভাগে বিভক্ত হতেও দেখা যায়। একটি পক্ষ আরেকটি পক্ষকে প্রতিপক্ষ ভেবে একধরনের সরব ও নীরব যুদ্ধও চলমান রেখেছে।
মূলত উপরোক্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর পুরোটাই নির্ভর করছে আপনি কি উদ্দেশ্যে আইন পড়তে চান তার ওপর। আমি মনে করি আইন পড়া শুরুর পূর্বেই লক্ষ্য স্থির করে নেয়া আবশ্যক যে আপনি কেন আইন পড়তে চান। সত্যি বলতে, আমি নিজেও আমার আইন পড়ার উদ্দেশ্য এর ব্যাপারে তেমন কিছু না ভেবেই আইন পড়া শুরু করেছি বলা চলে!
🌍মূল আলোচনা শুরু করার পূর্বে জেনে নেয়া যাক বাংলাদেশে কোন প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের কোর্সে আইন পড়ার সুযোগ রয়েছে –
১🔰 পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় – এলএলবি অনার্স (চার বছর মেয়াদী)
২🔰বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় – এলএলবি অনার্স (চার বছর মেয়াদী)
৩🔰 জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে আইন কলেজসমূহ – এলএলবি পাস কোর্স (দুই বছর মেয়াদী)
উপরোক্ত তিন ধরনের প্রতিষ্ঠানেই মোট আইন শিক্ষার্থীদের ৯৫ ভাগ পড়ে থাকেন।
৪🔰 বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বাংলাদেশে অবস্থিত সেন্টারসমূহ – যাকে আমরা ব্রিটিশ ল’ বলি, যেমন ভূঁইয়া একাডেমি (এ ব্যাপারে আমার খুব বেশি জানা নাই – এর ভালমন্দ নিয়ে তাই কিছু বলছি না)
৫🔰 উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি অনার্স (চার বছর মেয়াদী) কোর্স ।
🌎আপনি যদি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সুযোগ পান তবে আপনার আইন পড়ার উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, আপনার আইন পড়ার আগ্রহ থাকলে আপনি সেখানে পড়তে পারেন। এক্ষেত্রে সমীকরণ মিলানোর তেমন আর কিছু নাই। এক্ষেত্রে একটি বিষয়ই একটু আমলে নেয়ার দরকার হয় যে, ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি কোথায় অবস্থিত।
🌍আপনি যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সুযোগ না পান তাহলেও হতাশ হওয়ার ন্যূনতম কোন যৌক্তিক কারন নাই। জানেনই তো যে, শেষ ভাল যার-সব ভাল তার! সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে আপনাকে ভাবতে হবে যে, আপনি কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে – এলএলবি অনার্স (চার বছর মেয়াদী) কোর্স এ ভর্তি হবেন নাকি কোন অন্য কোন বিষয়ে স্নাতক পড়া শেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা এলএলবি পাস কোর্সে (দুই বছর মেয়াদী) ভর্তি হবেন। এক্ষেত্রে আমার অভিমত হচ্ছে, যদি আপনার আইন পড়ার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আইনজীবী হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে – বিজেএস বা বিসিএস কোয়ালিফাই করা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষকতা করা এসবও যদি আপনার উদ্দেশ্য হয় তাহলে আপনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সুযোগ না পেলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে আপনার সে লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনার মেধা ও তার যথাযথ প্রয়োগ, দক্ষতা, শ্রম আপনাকে আপনার প্রত্যাশিত জায়গায় নিয়ে যাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইন ডিগ্রিধারীরা এখন বিজেএস, বিসিএস বা বিশ্বিবদ্যালয়ের শিক্ষকতায় কর্মরত আছেন। সুতরাং পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়তে পারেননি এই আক্ষেপে হতাশ হওয়া বা হীনমন্যতায় ভোগা নিতান্তই বোকামি। আমি নিজেও যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়া শুরু করেছিলাম তখন এক ধরনের সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিলাম যা ছিল নিতান্তই বোকামি। সেই ভুল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সঠিক উপলব্ধি অর্জনে কেটে গেছে বহু সময়। যারা বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ছেন তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, আপনি শুধু মনে রাখবেন আপনি আইন শিক্ষার্থী। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তা বেমালুম ভুলে যান। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতে যা কিছু হওয়ার সুযোগ রয়েছে তা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্যাপারটা নির্ভর করছে আপনি নিজেকে কতটা যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবেন তার ওপর।
🌎অপরদিকে আপনার আইন পড়ার উদ্দেশ্যে যদি হয় শুধুমাত্র অ্যাডভোকেট হওয়া তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছর মেয়াদি ব্যাপক ব্যায় সাপেক্ষ অনার্স কোর্স না পড়ে অন্য কোন সাবজেক্ট এ স্নাতক শেষ করে দুই বছর মেয়াদী কোর্সে আইন পড়া শেষ করাকেই আমার বিবেচনায় ভাল সিদ্ধান্ত মনে হচ্ছে। বিভিন্ন যৌক্তিক দিক বিবেচনায় এটা আমার মতামত, কারো দ্বিমতও থাকতে পারে। আমার বিবেচনায় এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বড় অংকের একাডেমিক খরচ বাচাঁনো ও আইন পেশার মত সংগ্রাম ও কঠিন পরিশ্রম নির্ভর পেশায় যদি আপনি টিকতে না পারেন তাহলে সহজেই অন্য পেশায় বা কাজে স্থানান্তরিত হতে পারবেন আবার সুযোগ বুঝে ব্যাক করতে পারবেন। অন্যদিকে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশায় কাজ করতে চাইলে কে কোথায় পড়েছেন, অনার্স নাকি পাস কোর্স পড়েছেন এগুলো বিবেচ্য বিষয় নয়। সকলের জন্যই পেশায় ভাল করার সমান সুযোগ রয়েছে, এটা আপনার দক্ষতা অর্জন ও শ্রমের ওপর নির্ভর করবে। তবে যদি আপনার আর্থিক টানাপোড়ন না থাকে তাহলে আপনি আপনার ইচ্ছামাফিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
অনেকের প্রশ্ন থাকে আইনের দুই বছরের কোর্সে পড়ে বিজেএস দেয়া যাবে কিনা। হ্যা, বয়স অতিক্রান্ত না হওয়া ও ফলাফল দ্বিতীয় শ্রেণির থাকা সাপেক্ষে বিজেএস পরীক্ষা দেয়া যাবে।
🌎উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম হলো এই যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আইন পড়ার সুযোগ পান সেক্ষেত্রে আর সমীকরণ মিলিয়ে নেয়ার কিছু নাই, নিঃসঙ্কোচে পড়া যেতে পারে। তবে ঢাকার বাইরের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের ল ফ্যাকাল্টি খুব বেশি পুরনো নয় সেখানে পড়ার একটা নেতিবাচক দিক হলো, পড়ালেখা শেষ করে ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট এর জন্য আবার আপনাকে ঢাকায় ফিরতে হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আপনার নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেকটা বেগ পেতে হতে পারে।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না হলে আপনার আইন পড়ার উদ্দেশ্য ও সার্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের LL.B অনার্স কোর্সে বা অন্য সাবজেক্ট পড়ার পরে পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে দুই বছর মেয়াদী LL.B কোর্সে পড়া যেতে পারে। মূল কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স এর পরিচয়ের বাইরে আপনার মেধা চর্চার আগ্রহ ও শ্রমই হবে আপনার সফলতার প্রধান নিয়ামক।
আশা করছি উপরোক্ত আলোচনা নবাগত আইন পড়ুয়া ও যারা আইন পড়বেন বলে ভাবছেন তাদের জন্য সহায়ক একটি দিকনির্দেশনা হবে।
সকলকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
লেখক: অ্যাডভোকেট; ঢাকা জজ কোর্ট।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।