কামরুল হাসান হীরা:
পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় তার নিজের জীবনI শত দুঃখ, কষ্ট, রোগ-শোক থাকা সত্ত্বেও মানুষ চায় পৃথিবীতে আরো কটা দিন বেঁচে থাকতেI বেঁচে থাকার শতচেষ্টা করলেও মানুষের মৃত্যু অবধারিত। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে,তা নিশ্চিত এবং চিরন্তন সত্যI এবার আসা যাক মূল আলোচনায়, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত সমাজে নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটেI তারমধ্যে, অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যু একটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনাI তাছাড়া, পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসা কিংবা পেশাগত কারণে অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছেI উদ্দেশ্যমূলক হত্যাকান্ড অথবা আত্মহত্যার পিছনে নানা প্রকারের রহস্য লুকিয়ে থাকেI উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পারিবারিক কারণে আত্মহত্যা বা খুন; সামাজিক কারণে জমিজমা দখলদারিত্ব নিয়ে খুনাখুনি, রাজনৈতিক কারণে হানাহানি, পেশাগত কারণে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দ্বারা গুম বা খুন ইত্যাদিI প্রতিনিয়ত সমাজে ঘটে যাওয়া এ সকল অপমৃত্যুর খবর সংবাদপত্র বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যেমন: অজ্ঞাত পচা গলা লাশ উদ্ধার, ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার,বস্তা বন্দি লাশ, হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার, লাগেজ ভর্তি লাশ, মস্তক উদ্ধার, গলা কাটা লাশ উদ্ধার, টুকরো টুকরো লাশ উদ্ধার, রহস্যজনক মৃত্যু, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে যাত্রীর মৃত্যু, ক্ষতবিক্ষত লাশ, শ্বাসরোধে মৃত্যু, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু, নানান ধরনের আত্মহত্যা, পানিতে ভেসে আসা লাশ, ডেকে নিয়ে খুন, কবর থেকে লাশ উত্তোলন, দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন ছাড়াও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মানুষের অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যু ঘটে থাকেI এসকল মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটন, বিচার এবং শাস্তি প্রয়োগ করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং কর্তব্যI এই লেখাটি সংবাদপত্র, সাময়িকী, অনলাইন নিবন্ধসমূহ ভিত্তিক গবেষণা, যার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ময়নাতদন্তের সার্বিক পর্যালোচনাI
- ময়নাতদন্তের ইতিহাস
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বলা যায়, প্রাচীন গ্রীক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ময়নাতদন্ত সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলনাI যার ফলে, যেকোনো মৃত্যুর পর মৃতদেহকে সরাসরি দাহ করা হতোI এছাড়াও, প্রাচীন রোমান, চাইনিজ এবং মুসলিমদের মাঝে ময়নাতদন্ত সম্পর্কে নানা রকমের কুসংস্কার বিদ্যমান ছিলI কিন্তু প্রাচীন রোমান শাসক জুলিয়াস সিজারের মৃত্যু এবং মৃত্যুর কারণ সন্ধানের জন্য প্রথম ময়না তদন্ত রীতি চালু হয়I এছাড়াও, প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে ময়নাতদন্তের প্রচলন ছিলI যেখানে মিশরীয়দের মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহকে মমি বানিয়ে রাখতI এক্ষেত্রে, মমি বানানোর পূর্বে মৃতের শরীরের বিভিন্ন অংশ সংরক্ষণ করে রাখা হতোI প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া প্রচলিত থাকলেও যার কিছু ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিলI তাছাড়া, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ময়নাতদন্তের আধুনিকায়ন বা আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু হয়I সে থেকেই, জিওভান মরগাগনিকে আধুনিক যুগের ময়নাতদন্তের জনক বলা হয় I তাই বলা যায় যে, ময়নাতদন্তের সাথে ইতিহাস, ধর্ম, আইন এবং চিকিৎসাশাস্ত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িতI
- সুরতহাল -ময়নাতদন্ত -ভিসারা প্রতিবেদনের সামঞ্জস্যতা
ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৮৯) ধারা১৭৪ অনুযায়ী নিকটস্থ থানার যেকোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যুজনিত মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট বা প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষমতা রাখেনI এইক্ষেত্রে, দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করবেনI একইসাথে ঘটনাস্থলে পৌছামাত্র মৃতব্যক্তির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করাসহ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবেনI বাস্তব প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায়, যেকোনো অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যুর খবর পাওয়ার সাথেসাথে নিকটস্থ থানা পুলিশকে অবহিত করতে হয়I অতঃপর, শুরু হয় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ, লাশ উদ্ধার বা পরবর্তী তদন্ত প্রক্রিয়াI প্রাথমিকভাবে তদন্ত প্রক্রিয়ার কাজ হল মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধান করাI আর এই অনুসন্ধান বা তদন্তকে ময়নাতদন্ত বলা হয়I নিকটস্থ থানা পুলিশ অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্র লাশ উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে যতদ্রুত সম্ভব উপস্থিত হনI পরবর্তীতে, উক্ত লাশের অবস্থান শনাক্ত করে লাশটির সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেনI সুরতহাল রিপোর্ট এর প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হল মৃতদেহের অবস্থান নির্ধারণ করা এবং মৃতদেহের বাহ্যিক অবয়বের সঠিক, স্বচ্ছ এবং নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করাI একটি সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করার সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উক্ত রিপোর্টে উপস্থাপন করেনI উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সুনির্দিষ্ট মামলা বা জিডি নাম্বার, তারিখ, মৃতের নাম, বয়স, ঠিকানা, লিঙ্গ, ধর্ম, গোত্র, ঘটনাস্থল, মৃতদেহের অবস্থান, মৃতদেহের পোশাক, মৃতদেহের দাড়ি-গোঁফ-চুলের বর্ণনা, শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটা-ক্ষত দাগ বা চিহ্ন, যেকোন আঘাত বা দাগ বা জব্দকৃত আলামতের বিবরণ সুরতহাল রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়I এছাড়া, যেদিন সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হবে সেইদিনের তারিখ উল্লেখসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের নাম-পদবী-ঠিকানা এবং উপস্থিত সাক্ষীদের (২জন) নাম, ঠিকানা এবং স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়I সুরতহাল রিপোর্টে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর বিবরণ স্পষ্ট উল্লেখ থাকলে তৎপরবর্তী তদন্ত বা অনুসন্ধান কাজ অনেকটাই সহজতর হয়I স্বাভাবিকভাবে, সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করার সময় মৃত্যুর কারণ সন্দেহজনক মনে হলে সাথে সাথেই সরকার অনুমোদিত নিকটস্থ হাসপাতলে পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাতে হয়I যদি কোন ব্যক্তি পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন, তখন প্রশ্ন জাগে সুরুতহাল রিপোর্ট কে তৈরি করবেনI এক্ষেত্রে, ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৮৯) ধারা ১৭৬ অনুযায়ী, একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি হয়I
পোস্টমর্টেম, অটোপসি, নেক্রপসি বা ময়নাতদন্তের অর্থ হলো অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করাI মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ফরেনসিক ডাক্তার বা সিভিল সার্জন মৃতদেহের বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ এবং বিভিন্ন অঙ্গ বা অঙ্গবিশেষের গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করেনI সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ পূর্বক আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেনI এই সিদ্ধান্তের আলোকে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয় তাকে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বলা হয়I কেননা মামলা পরিচালনায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়I ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করার আগে এবং পরে অনেক বিষয় জড়িত থাকে, এই প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশের আই.জি.পি মোহাম্মদ নূরুল আনোয়ার মনে করেন, সুরতহাল, ময়নাতদন্ত এবং ভিসারা রিপোর্ট একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িতI ময়নাতদন্ত সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকেI যেমন: (১) মেডিকেল ময়নাতদন্ত : থানা পুলিশ কর্তৃক প্রচলিত ময়নাতদন্তকে মেডিকেল ময়না তদন্ত বলা হয়; (২) ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত : হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোন রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে, মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান বা তদন্তকে ক্লিনিক্যাল ময়না তদন্ত বলা হয়; এবং (৩) একাডেমিক ময়নাতদন্ত : প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ডাক্তার কিংবা শিক্ষানবিশ ডাক্তারদের ব্যবহারিক শিক্ষা বিষয়ক তদন্তকে একাডেমিক ময়না তদন্ত বলা হয়I মেডিকেল বা সাধারণ ময়নাতদন্ত আবার দুই ধরনের হয়ে থাকেI যার একটি হল বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ এবং অন্যটি অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণI
সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা মৃতদেহের যে বাহ্যিক তথ্য সংগ্রহ করেন তাকে বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ বলা হয়I উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেমন: চোখ, নাক, মুখ, কান, চুল, বুক, পেট, পিঠসহ অন্যান্য স্থানের পর্যবেক্ষণ করা I কোন কোন ক্ষেত্রে, বাহ্যিক পর্যবেক্ষণের পর অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যকীয় হয়ে পড়েI যেমন, সন্দেহজনক মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করার জন্য মৃতদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বা অঙ্গবিশেষের গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজনI বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ফরেনসিক ডাক্তার বা সিভিল সার্জন ডাক্তার তাদের সিদ্ধান্ত রিপোর্ট আকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর করেনI তবে ক্ষেত্র বিশেষে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা না গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ভিসারা পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হয়I এইক্ষেত্রে ময়নাতদন্তকালীন সময় মৃতদেহ থেকে ভিন্নভিন্ন অঙ্গ বা অঙ্গবিশেষ, যেমন: পাকস্থলী, লিভার বা যকৃৎ, কিডনি, ফুসফুস এবং অন্ত্রনালী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তৎপরবর্তী পরীক্ষার জন্য সরকার অনুমোদিত ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হয়I অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা,পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার একটি ভিসারা রিপোর্ট তৈরি করেনI ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সঠিক, স্বচ্ছ এবং নির্ভুলভাবে তৈরি হয়েছে কিনা তা যাচাই করা একান্ত জরুরীI এইক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন : যেমন: (১) মৃতদেহে নির্দিষ্ট ট্যাগ লাগানো ছিল কিনা; (২) মৃতদেহ আসতে কত সময় লেগেছে বা কত সময় লাগার কথা বা কেন দেরি হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ আছে কিনা; (৩) ময়নাতদন্ত সরকার অনুমোদিত নির্দিষ্ট হাসপাতল কিংবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে সম্পন্ন হয়েছে কিনা; (৪) সম্পূর্ণ ময়নাতদন্ত একজন অভিজ্ঞ ফরেনসিক চিকিৎসক দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে কিনা; (৫) ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশক্রমে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে কিনাI যদি বিলম্ব হয়ে থাকে তার কারণ যাচাই করা; (৬) দিনের আলোতে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে কিনাI
- ময়নাতদন্তের নানারূপ সমস্যা ও প্রতিকার
বাস্তব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, এক ময়নাতদন্তকে ঘিরে ভিকটিমের পরিবার, পুলিশ প্রশাসন, দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং রাষ্ট্র নানান প্রশ্নে জর্জরিত হয়I পাশাপাশি সংবাদপত্র বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ময়নাতদন্ত নিয়ে নানান সংবাদ প্রকাশিত হয় I যেমন: ময়নাতদন্তের জন্য আটকে আছে মামলা; একাধিক ময়নাতদন্ত হওয়ার পরেও তদন্ত রিপোর্টে তথ্যের গরমিল; মোমবাতি জ্বালিয়ে ময়নাতদন্ত; পুলিশের দাবি উপেক্ষা করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে খুনের প্রমাণ; টাকার বিনিময় ময়নাতদন্ত; কবর থেকে লাশ তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত ইত্যাদিI
ফৌজদারি মামলায় সুরতহাল, ময়নাতদন্ত এবং ভিসারা রিপোর্ট যা একটির সাথে অপরটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যI ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোন মেডিকেল আইন না থাকার কারণে ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া এখনো পুরনো এবং মান্ধাতা আমলের নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হয়I তাছাড়া, তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং বিচারকদের মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স সম্পর্কে বাস্তবজ্ঞান এবং উন্নত প্রশিক্ষণের অভাব থাকায় তদন্ত এবং সার্বিক বিচার প্রক্রিয়ায় নানা রকমের সমস্যা তৈরি করেI উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উন্নত ও সময় উপযোগী প্রশিক্ষণের অভাব, পেশাগত অবহেলা কিংবা অজানা কারণে অসম্পূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত এবং সন্দেহমূলক রিপোর্ট তৈরি হয়I ফলশ্রুতিতে, সুরতহাল রিপোর্টের সাথে ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অমিল অথবা ময়নাতদন্তের সাথে ভিসেরা রিপোর্টের গরমিলI এমনকি আদালতের নির্দেশক্রমে, মৃত লাশ কবর থেকে উঠিয়ে পুনরায় ময়না তদন্ত করা হয়I যার ফলে, মৃতলাশের একাধিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে নানারকমের আইনি সমস্যা তৈরি হয়I এছাড়াও, দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক ময়না তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল বিলম্বিত হলে সার্বিক বিচার প্রক্রিয়ায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত ঘটেI ফলস্বরূপ, মামলার রায় পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়I যা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিপন্থীI
ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ২০০৬ সালে সর্বমোট ৩০১২টি পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করেI যেখানে, মোট ময়নাতদন্তের ৫৪% দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যু; ২৪% আত্মহত্যা; ১৮% নরহত্যা; ১% স্বাভাবিক মৃত্যু; এবং ৩% মৃত্যুর কারণ অনির্ধারিত ছিলI উক্ত ময়নাতদন্তের মধ্যে৭৫% ছিল পুরুষ এবং ২৫% নারীI দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মোট পুরুষের মধ্যে ৭৫% পুরুষই ছিল অস্বাভাবিক মৃত্যু বা অপমৃত্যুর শিকারI যেখানে, বেশিরভাগ পুরুষই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলনI অন্যদিকে, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, জানুয়ারি ১৯৮৮ সাল থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ২৫৩৪টি ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়I যার মধ্যে ২৭৩টি ময়নাতদন্ত ছিল বিক্রিয়ার ফলে মৃত্যুI এই সংখ্যা মোট ময়নাতদন্তের ১০.৮%, যেখানে পুরুষ ৫৪.৪%I গবেষণায় আরও বেরিয়ে এসেছে যে হতাশা, অভাববোধ, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কারণে হত্যা বা আত্মহত্যার প্রবণতা দিনদিন বেড়েই চলছেI এসকল অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যু পরবর্তী সুরতহাল বা ময়নাতদন্ত বা ভিসারা রিপোর্ট তৈরি করতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা থাকতে হয়I এর ফলে মামলা বা বিচার পরিচালনা দীর্ঘায়িত হয়I
বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যখাত বা সেবায় আমূল পরিবর্তন হয়েছেI কিন্তু, ময়নাতদন্ত বা তৎসম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা পুরনো এবং মান্ধাতা আমলের প্রক্রিয়ার উপর আজও নির্ভরশীলI এছাড়াও, ময়নাতদন্ত বা ভিসারা রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানারকমের সমস্যা সৃষ্টি হয়I যার ফলে, দেশের প্রায় সকল জেলাভিত্তিক ময়নাতদন্ত বা ভিসারা রিপোর্টের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হতে হয়I বাংলাদেশের ফরেনসিক বিভাগীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ময়নাতদন্ত (পোস্টমর্টেম) বা ভিসারা রিপোর্ট তৈরিতে অনেক সময় লাগেI
ময়নাতদন্ত রিপোর্ট মামলা পরিচালনা বা বিচারকার্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়I তাই, ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়াকে আরো উন্নত এবং আধুনিক করার লক্ষ্যে নিম্নরূপ বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজনI যেমন:
- সরকারের সদিচ্ছা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে বাংলাদেশের জেলাভিত্তিক সরকারি হাসপাতালে, উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাI একইসাথে, উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ ফরেনসিক ডাক্তার বা সিভিল সার্জন নিয়োগ দেওয়াসহ সার্বিক, টেকসই উন্নয়ন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলেই ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভবI
- শর্তসাপেক্ষে, বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলাশহরে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর ফরেনসিক মেডিকেল সার্ভিস বা আধুনিক ল্যাবরেটরী (ফরেন্সিক, ক্লিনিক্যাল, ফরেন্সিক পথলজি) স্থাপন নিশ্চিত করতে হবেI পাশাপাশি, জেলাভিত্তিক আধুনিক মর্গ প্রতিস্থাপন এবং পোস্টমর্টেম প্রক্রিয়ার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবেI
- ময়নাতদন্ত বা ভিসারা রিপোর্টের উল্লিখিত প্রতিটি শব্দ ও শব্দগুচ্ছের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছেI অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিযুক্ত ময়নাতদন্ত বা ভিসারা রিপোর্ট মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ বা বিচারপ্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেI এছাড়া, ময়নাতদন্তের সাথে সম্পৃক্ত সিভিল সার্জন ডাক্তাররা বাংলাদেশের প্রচলিত মেডিকেল আইন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন নাI এমনকি যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করার সময় নানা প্রকার অবহেলা, অনিয়ম এবং আইন বহির্ভূত কার্যকলাপের সাথে জড়িয়ে পড়েনI তাই যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানোর জন্য ময়নাতদন্ত বা ভিসারা রিপোর্ট তৈরীর ক্ষেত্রে এক এবং অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবেI
- বিচারাধীন যেকোনো মামলা-মোকদ্দমায় রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত করা উচিত নয়I কেননা, রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত থাকার কারণে যেকোনো অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যুজনিত হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মামলায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে নানা প্রকারের সমস্যা হয়I উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জনৈক ছাত্রনেতা হত্যার ঘটনায় দুইবার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়I প্রথম ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নানান প্রশ্নের জন্মদিলেও, দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের সাথে ভিকটিমের পরিবার কিছুটা সন্তুষ্ট হয়I তাই এবিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজনI
- বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগে নিয়োজিত আছেI এসকল পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থেকে কিছু সদস্যকে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তদন্ত সম্পর্কিত দক্ষতা বাড়ানো সম্ভবI পাশাপাশি, দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ বা তদন্ত কর্মকর্তা, ফরেনসিক ডাক্তার, সরকারি আইনজীবী এবং বিচারকদের মধ্যে সমন্বয় করা এবং উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরিI এইক্ষেত্রে যৌথভাবে থানা এবং জেলাভিত্তিক বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজন করতে পারলে মামলার তদন্ত বা বিচার সংশ্লিষ্ট যেকোনো সমস্যা সমাধান করা সম্ভবI
অস্বাভাবিক মৃত্যু বা অপমৃত্যু সম্পর্কিত যেকোনো হত্যা বা আত্মহত্যার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাথে সাথে আসামীপক্ষও ন্যায় বিচার পাবার দাবিদারI তবে, অসম্পূর্ণ ময়নাতদন্ত কিংবা একাধিক ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তথ্যের গরমিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায়I আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা অনেক সহজলভ্যI যেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যেমন: প্যাথলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল, কেমিক্যাল অ্যান্ডসেরোলজিক্যাল ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুতমৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা যায়I কেবলমাত্র, সঠিক স্বচ্ছ এবং নির্ভুল ময়নাতদন্তই অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করতে পারেI সর্বোপরি, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ময়নাতদন্তের আধুনিকায়ন করা এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আইন সংশোধন বা সময় উপযোগী মেডিকেল আইন প্রণয়ন করা অবশ্যই প্রয়োজনI
লেখক: পি. এইচ. ডি.গবেষক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী