মানব পাচারের ‘সাজানো’ মামলায় কক্সবাজারের শিশু আসামি আলাউদ্দিনকে আট সপ্তাহের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ সময় আদালত শিশু আলাউদ্দিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ও তো এখনও মানবই হতে পারেনি, মানবপ্রাচার করবে কীভাবে?’
এ-সংক্রান্ত এক আবেদনের শুনানি নিয়ে আজ সোমবার (২৮ অক্টোবর) হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে আজ আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জামান আক্তার বুলবুল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একদম মাইনর (নাবালক) ছেলে। সর্বোচ্চ ১২ বছর হবে। আদালত তাকে ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন।’
শিশুর আইনজীবী জামান আক্তার বুলবুল বলেন, ঘটনা দেখানো হয়েছে ১৪ সালের। আর মামলা করেছে ১৮ সালে। কিন্তু এখন তার বয়স ১২ বছরের মতো।
১২ বছর বয়সী কওমী মাদরাসার ছাত্র আলাউদ্দিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে মানবপাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য। মামলাও হয়েছে। বেশ কয়েকদিন পালিয়েও বেড়িয়েছে। উপায়ান্তর না পেয়ে মা-কে নিয়ে দ্বারস্থ হয়েছেন হাইকোর্টে।
জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো মানুষকে বোঝাবে’। এ অর্থে ১২ বছর বয়সী আলাউদ্দিনকে শিশু-ই বলা যায়। কিন্তু মামলায় আলাউদ্দিনের বয়স দেখানো হয়েছে ২২।
ওই মামলায় সোমবার হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে আসেন আলাউদ্দিন। সঙ্গে তার মা রিজিয়া বেগম। কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার চাকমারপুল এলাকার মৃত ইলিয়াসের দ্বিতীয় স্ত্রী রিজিয়া বেগমের গর্ভের সন্তান আলাউদ্দিন। রিজিয়া বেগমের সাত ছেলে-মেয়ের মধ্যে আলাউদ্দিন চতুর্থ।
আলাউদ্দিনের মা রিজিয়া বেগম বাসাবাড়িতে কাজ করেন। ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের। বাবা দুই বিয়ে করেন, প্রথম ঘরের স্ত্রীর বড় ছেলেদের সঙ্গে শত্রুতার জেরে তাকে ২০১৮ সালে দায়ের করা মানবপাচার মামলায় আসামি করা হয়। আলাউদ্দিন স্থানীয় জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদরাসার কওমী ইয়াজদাহুম বিভাগের ছাত্র।
মা রিজিয়া বেগম বলেন, ‘আমি বাসাবাড়িতে কাজ করি। একবেলা ভাত নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়াই। মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে ওদের পড়ালেখা খরচ জোগাতে পারছি না। ছেলে-মেয়েরা যখন খায় তখন আমি পেটে কাপড় বেঁধে রাখি যাতে আমার পেট উঁচু থাকে। সন্তানরা যাতে বুঝতে পারে যে, আমিও খেয়েছি।’
কান্না করতে করতে তিনি আরও বলেন, ‘কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছি। এর মধ্যে সম্পত্তির লোভে আমার নিষ্পাপ ছেলেটির বয়স বাড়িয়ে মানবপাচার মামলা দিয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছে। কী অপরাধ করেছিলাম আমরা? কী অপরাধ ছিল আমার এই ছেলের? তার তো মাদরাসায় যাওয়ার কথা, খেলাধুলা করার কথা কিন্তু আজ সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে! আজ এ আত্মীয়ের বাসায়, কাল ওই আত্মীয়ের বাসায়; এভাবে প্রতিদিন এখানে-সেখানে মামলা কাঁধে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে।’
আলাউদ্দিনের মা বলেন, ‘ছেলের মামলার খরচ চালানোর মতো টাকাও আমার হাতে নেই। আমি আর পারছি না, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার!’
রিজিয়া বেগমের সতিনের ছেলে রফিক জানান, হারুন নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে এ মামলা করানো হয়েছে। কে এই হারুন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের নির্দেশে মামলা করা হয়েছে তাদের নাম বললে আমার ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে।
এ সময় আলাউদ্দিনের মা রিজিয়া বেগম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাছে সন্তানকে বাঁচাতে আকুল আবেদন জানান। বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি মা, আমিও মা। আমি ন্যায়বিচার চাই, আমার এই নিষ্পাপ শিশুটিকে আপনি বাঁচান। মামলাবাজ প্রতারক চক্রের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করুন।’
অভিযোগ করে রিজিয়া বেগম জানান, মামলার বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায় গত ১৫ অক্টোবর তাদের খুপড়ি ঘর ভেঙে দেয় তার সতিনের ছেলেরা। আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, থালাবাসন লুট করার পাশাপাশি ভাঙচুরও করা হয়। যার কারণে ভয়ে আর আতঙ্কে বাড়িছাড়া তারা।
এদিকে মামলার বাদী নুরুল ইসলাম জানান, তিনি কোনো আসামিকে চেনেন না। ঢাকা থেকে যেভাবে মামলা সাজানো হয়েছে সেভাবেই তিনি আসামিদের নামে মামলা দিয়েছেন। শিশু আলাউদ্দিন যে তার মামলার আসামি তাও তিনি জানেন না।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে আলাউদ্দিনের বয়স ২২ বছর। ১২ বছরের শিশু আলাউদ্দিন তো দূরে থাক, কোনো আসামিকেই আমি দেখিনি।’
একই মামলার অপর আসামি মীর আহমেদ মিলনকে দেখে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ওনাকেও চিনি না।’ কেন এমন মিথ্যা মামলা করলেন- জবাবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন সাজানো বাদী তিনি একা নন, শুধু কক্সবাজার জেলাতেই এমন বাদী আছেন বিশজনের মতো।’
‘পাশের গ্রামের হারুনও এমন সাজানো মানবপাচার মামলার বাদী। আহমেদ হোসেনকেও (পাশে থাকা ব্যক্তিকে দেখিয়ে) ঢাকায় এনেছিলাম মামলা করার জন্য’- বলেন নুরুল ইসলাম।
আহমেদ ও নুরুল ইসলাম জানান, মামলা করলে এককালীন ও মাসিকভিত্তিতে টাকা দেয় চক্রটি।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মামলা করে এক লাখ ২০ হাজার টাকা মতো পেয়েছি। তবে মীর আহমেদ মিলন ও শিশু আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা না চালাতে চাইলেও ওই চক্রের কারণে মামলাটি তুলতে পারছি না।’
আলাউদ্দিনের মতো এমন সাজানো মামলার আসামি হিসেবে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন চকোরিয়ার অশীতিপর বৃদ্ধ সৈয়দ জিন্নাত আলী কুতুবী। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় মানবপাচারের মামলা হয়েছে সাতটি। রামুর ঈদগড়ের তৈয়্যব উল্লাহও এমন সাজানো মামলার আসামি। শুধু মামলা দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না প্রতারক চক্রটি। মামলার খরচের নামে উল্টো ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পাশে অবস্থানকারী শক্তিশালী মামলাবাজ এ সিন্ডিকেট।
মামলায় জড়িয়ে ভুক্তভোগীদের কাবু করার পর তাদের জমি, ভিটেমাটি, সহায় ও সম্পদ কেড়ে নেয় চক্রটি। জিন্নাত আলী সাংবাদিকদের জানান, তিনিসহ বান্দরবানের লামায় পুনর্বাসিত শতাধিক পরিবারকে উচ্ছেদ করে সেটি দখলে নিয়েছে চকোরিয়ায় লাদেন মৌলভী খ্যাত আনিস হুজুর।
তৈয়ব উল্লাহর দাবি, দখলি জমিতে গাছের চারা লাগাতে তাকে বাধ্য করেন লাদেন হুজুর। গাছের চারা লাগানোর টাকা চাইতে গেলে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় ভুতুড়ে মানবপাচার মামলা হতে থাকে। কারাগারে থাকাবস্থায় এমন শতাধিক মানুষকে মামলার জালে ফেলে নিঃস্ব করে দেয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলেও দাবি জিন্নাত ও তৈয়বের।