মুবিন হাসান খান অয়ন:
চলচ্চিত্র হচ্ছে শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ। ছায়াছবির সাথে ভিজ্যুয়াল বিশ্বের সমন্বয় থাকায় সাধারণ মানুষের সাথে যে সমন্বয় ও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে তা আর অন্য কোন মাধ্যমে সম্ভব হয় না। তাই আমরা কোনকিছু পড়লে যতটা মনে রাখতে পারি তার চেয়ে বেশি মনে রাখা সম্ভব হয় কোন কিছু ভিজ্যুয়ালাইজ করলে। যেটা আমরা করে থাকি সাধারণত কোন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ব্যাবহৃত আইন যত, আইন সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা তত। আইন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় সরকারকে আইন বাস্তবায়নেও প্রচুর বেগ পোহাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি এর উপরে। অথচ আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি গুটিকয়েক যা জনসংখ্যার তুলনায় অনেকাংশেই কম। যার ফলে কোন বিষয়ে আইন তৈরি হয়ে থাকলেও সাধারণ জনগণ তা চর্চা করতে পারছেনা শুধুমাত্র না জানার কারণে।
দেখা গেল মফস্বল এলাকার একজন ব্যক্তি সদ্য মোটরসাইকেল কিনে নিয়মাবলী না জেনেই সে রাস্তায় উঠে পড়ল। একমুখী চলাচলের রাস্তায় সে ডান দিকে দিয়ে চালানো শুরু করে দিল এবং ট্রাফিক সার্জেন্ট তাকে মামলা দেয়ার পরিক্রমা শুরু করলেন। মোটরসাইকেল চালক কিছু বুঝে উঠার আগেই ট্রাফিক সার্জেন্ট তাকে, ১৯৮৩ সালের ‘মোটরযান আইন’ এর ধারা ১৪০(২) অনুযায়ী ওয়ানওয়ে সড়কে বিপরীত দিকে গাড়ি চালানোর জন্য ২০০ টাকা জরিমানা করেন। আইন না জানার ফলে অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়ার কথা স্বীকার করলেও ট্রাফিক পুলিশ তাকে জানান যে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন।
আইনশাস্ত্রের একটি পরিচিত প্রবাদ বাক্য হল “Ignorance of Law is not an excuse” অর্থাৎ, আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা কোন অজুহাত নয়। একজন সুনাগরিক হিসেবে আইন জানার কোন বিকল্প নেই। কোন নাগরিক আইন না জানার ফলে যদি কোন অপরাধ করে এবং প্রমাণ করতে চায় যে অজ্ঞতাবসত কাজটি তার দ্বারা হয়েছে সেক্ষেত্রে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। অজ্ঞতার অজুহাত দিয়ে আইজে কেউ পার পাবেনা।
ফলশ্রুতিতে দেখা যায় আমাদের দেশের বেশিরভাগ আইন ভঙ্গ হয় শুধুমাত্র নাগরিকের আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। পুলিশি তৎপরতার মাধ্যমে মাঝেমধ্যে কিছু আইন জনগনের জানা হলেও বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের জ্ঞানের আওতার বাইরেই থেকে যায় আইনের ধারণা। আইনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, আইনহজীবী, বিচারক কিংবা আইন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব বেশি মানুষ আইনের ধারণা রাখেনা।
তাই আইন সম্পর্কে যদি সুন্দর করে কোন চলচিত্র তৈরি করা যায় তবে সেক্ষেত্রে আইনের ব্যবহার ও আইন ভঙ্গের শাস্তি সম্পর্কে নাগরিক সচেতন হতে পারবে এবং একিসাথে আইন পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও তাদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও কিছু ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারবে যা পরবর্তীতে তাদের আইন প্রণয়নে সহায়তা করবে।
আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারত ইতমধ্যে কিন্তু চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নাগরিকদের সচেতন করার উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভারতে একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে যার নাম “Article 15” অর্থাৎ ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ১৫ নিয়ে এই সিনেমাটি তৈরি হয়েছে, যেখানে খুব সুন্দরভাবেই হিন্দুদের কাস্ট সিস্টেমের দ্বারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি এবং আইনের মাধ্যমে কিভাবে তা সংশোধন করা যায়, সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
শুধু “Article 15” নয়, এরকম অনেক সিনেমা রয়েছে যা শুধু সাধারণ জনগণ নয় বরং আইনের প্রতিটি স্তরে থাকা মানুষদের সহয়তা করবে এবং মানুষ কে আইন মানতে অনুপ্রাণিত করবে।
যদি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা আইনের বিষয়বস্ত নিয়ে চলচিত্র নির্মানের উদ্যোগ নেয় তবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী উভয়ের উপরেই তার প্রভাব ফেলবে। মাতৃভাষা বাংলায় যদি আইনের সিনেমা বানানো হয় এবং তা যদি হয় দেশের চলমান বিষয় নিয়েই তবে সাধারণ মানুষ আইন সম্পর্কে যেমন অবগত হবে একিভাবে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও প্রাণ ফিরে পাবে।
উদাহরণস্বরূপ যদি বাংলাদেশের বহুল আলোচিত নুসরাত হত্যা নিয়েই যদি কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায় এবং এর বিচারিক প্রসিডিউর গুলো যদি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায় সেক্ষেত্রে দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তা ধর্ষণ কমিয়ে আনতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে। সাধারণ মানুষের কাছে আইনি প্রক্রিয়া জটিল হওয়ার কারণে অনেক ধর্ষিতাকেই মুখ চেপে থাকতে হয়। যদি সিনেমার মাধ্যমে হলেও কেউ আইন সম্পর্কে প্রায়োগিক ধারণা পায় তবে তা শুধু একটি স্বার্থক চলচ্চিত্রই নয় বরং এটি হবে সাধারণ মানুষের একটি হাতিয়ার।
সর্বোপরি বলা যায়, আইন ভিত্তিক সিনেমা তৈরি হতে পারব জনসাধারণের জন্য আইনজ্ঞান লাভ করার একটি মাধ্যম, এবং বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্বের দরবারে আইন মান্যের একটি রোল মডেল।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, জেড.এইচ.সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।