দেশের প্রতিটি কারাগারে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি বন্দি অন্তরীণ। তিলধারণের ঠাঁই নেই দেশের কোনো কারাগারে। প্রচণ্ড গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন কাটানো এসব বন্দি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পায় না প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাটুকুও। পাবেই বা কীভাবে। দেশের সব কারাগারে ১৪১ পদের বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১০ জন।
হাজতি ও কয়েদি হিসাবে কারাগারে আসেন বন্দিরা। ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে তাদের সিভিল বন্দি, বিচারাধীন বন্দি, মহিলা বন্দি, ২১ বছরের নিচে পুরুষ বন্দি, ষাটোর্ধ্ব বন্দি, বয়ঃসন্ধিতে উপনীত না হওয়া পুরুষ বন্দি এবং অন্যান্য সাজাপ্রাপ্ত পুরুষ বন্দি হিসেবে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। যেসব বন্দির বিচারকাজ শেষ হয়নি বা নির্ধারিত তারিখে যাদের আদালতে হাজির করা হয় তারা হাজতি বন্দি হিসেবে থাকে।
হাইকোর্টে জমা দেওয়া কারা অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশের সব কারাগারে এ ধরনের মোট ৮৬ হাজার ৯৯৮ জন বন্দি রয়েছে। অথচ দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগারের মোট ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৬৬৪ জন। আর এ কারণে প্রতিটি কারাগারে এখন বন্দিদের চরম দুরবস্থা চলছে। ঘুমানোর জায়গা পর্যন্ত হয় না অধিকাংশ কারাগারের বন্দিদের। চরম মানবেতর জীবন কাটাতে হয় সব শ্রেণির বন্দিকে।
সারা দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার আছে। এগুলো হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২, কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার, রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার।
এর মধ্যে কারা অধিদফতরের দেওয়া (চলতি বছরের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত) তথ্য মতে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৫৯০। অথচ বন্দি রয়েছে ১০ হাজার ৮১৮ জন। এমন চিত্র সবগুলো কেন্দ্রীয় কারাগারেই।
এছাড়া ঢাকা বিভাগের কারাগারগুলোর মোট বন্দির ধারণক্ষমতা ১২ হাজার ৫৯২ জন। বর্তমানে রয়েছে ৩০ হাজার ৯৮৫ জন। চট্টগ্রাম বিভাগের কারাগারগুলোর অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। এই বিভাগের সবগুলো কারাগারের ধারণক্ষমতা ৬ হাজার ৩৭৪ জন হলেও বন্দি রয়েছে ২০ হাজার ৬৭৯ জন। অর্থাৎ প্রায় তিনগুণ। রাজশাহী বিভাগের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৭৫ জন। রয়েছে ১০ হাজার ৬৫৯ জন। সিলেট ও রংপুর বিভাগের অবস্থা অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় কিছুটা ভালো। এই দুই বিভাগে কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা যথাক্রমে ৪ হাজার ৪৬১ ও ৪ হাজার ৪৪৭ জন। রয়েছে যথাক্রমে ৫ হাজার ২৫ ও ৫ হাজার ৪৫৮ জন। খুলনা বিভাগের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৯৯৯ জন। রয়েছে ৬ হাজার ৯১৬ জন। বরিশাল বিভাগে ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৯১৩ জনের বিপরীতে আছে ৩ হাজার ৩৭৯ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগের কারাগারগুলোতে ১ হাজার ৮০৩ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে আছে ৩ হাজার ৮৯৭ জন।
অন্যদিকে দেশের কারাগারগুলোতে কারা চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ ১৪১টি। কিন্তু কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ১০ জন। গত মঙ্গলবার কারা অধিদফতরের পক্ষে আদালতে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশের কারাগারগুলোতে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৬৬৪। তবে বন্দি রয়েছে ৮৬ হাজার ৯৯৮ জন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত বছরের ২৮ জানুয়ারি ২০ জন ডাক্তার প্রেষণে কারাগারে বদলি করলেও তাদের মধ্যে চারজন যোগদান করেছেন। অবশিষ্ট ১৬ জন যোগদান করেননি। যোগদান না করা ডাক্তাররা হলেন- ডা. ঝুমা সাহা, ডা. ফারুক আল মামুন, ডা. মো. আরিফুর রহমান, ডা. গোলাম মোস্তফা, ডা. সাইদুজ্জামান, ডা. ফজলুল করিম, ডা. আবদুল্লাহ হেল ওয়াকী, ডা. আবু সালেহ আহমেদ, ডা. কামরুজ্জামান খান, ডা. একেএম রেজাউল ইসলাম খান (নিপুণ), ডা. ইশতিয়াক আলম, ডা. মো. শাহাদাৎ হোসেন, ডা. কাজী মো. রফিকুল হাসান, ডা. সাইফ গোলাম রাব্বানী, ডা. মো. আরিফুর রহমান ও ডা. নাজিফা তাসসুম।
এই ডাক্তারদের কারাগারে যোগদান না করা ও সরাসরি ডাক্তার নিয়োগের বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম মোস্তফা কামাল পাশা স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব ডাক্তার প্রেষণে কারাগারে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য পাঠানোর পরও কাজে যোগদান করেননি তাদের ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে কারা অধিদফতর (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা ২০১১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী প্রেষণ ছাড়া সরাসরি ডাক্তার নিয়োগের বিধান নেই। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ কারণে বন্দিদের চিকিৎসা নিয়ে কর্তৃপক্ষ খুবই সমস্যার মধ্যে রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রিটকারী অ্যাডভোকেট রবিন বলেন, বন্দিদের এমন দুরবস্থা সত্যিই দুঃখজনক। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। কারা কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, কারাগারে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি বন্দি থাকায় তারা চরম দুরবস্থায় আছে। আবার তাদের নেই কোনো সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও। এ অবস্থায় বলা যায়, কারাবন্দিদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং এতে বন্দিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা।
এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দি রয়েছে। এতে বন্দিদের সবদিক থেকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তবে বর্তমান কারা মহাপরিদর্শক এই সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বন্দিদের বাসস্থানের লক্ষ্যে কেরানীগঞ্জে অত্যাধুনিক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়াও ২০০৯ সাল থেকে সর্বমোট ১৮টি কারাগার নির্মাণ বা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সারা দেশে নির্মাণাধীন রয়েছে ১০টি কারাগার। নতুন করে ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগারের জন্য।
চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের এই আইনজীবী জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে কারা কর্তৃপক্ষ শিগগিরই এ সমস্যা সমাধান করবে বলে জানিয়েছে। সূত্র- সময়ের আলো