দেশের সেরা করদাতার তালিকা প্রকাশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই তালিকায় থাকা করদাতাদেরকে ট্যাক্স কার্ড দেওয়া হবে। জাতীয়ভাবে এবার ব্যক্তি পর্যায়ে ৭৪টি, কোম্পানি পর্যায়ে ৫৭টি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ১০টিসহ মোট ১৪১টি ট্যাক্স কার্ড প্রাপ্তদের তালিকার গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। এছাড়া, প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও জেলা থেকে তিন জন সর্বোচ্চ করদাতা, দুজন দীর্ঘ সময় ধরে কর প্রদানকারী এবং একজন করে নারী ও তরুণ করদাতাকে মনোনীত করা হয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীর ভিত্তিতে তালিকাটি করা হয়েছে। আগামী ১৪ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে ১৪১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্স কার্ড তুলে দেবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
- যেভাবে সেরা করদাতা নির্ধারণ হয়
প্রথমত, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্য থেকে কারা কার্ড পাবেন— তা বাছাই করে এ বিষয়ে গঠিত একটি কমিটি। এই কমিটি ‘জাতীয় ট্যাক্স কার্ড নীতিমালা-২০১০ (সংশোধিত)’ অনুসরণ করে ট্যাক্স কার্ড প্রাপ্তদের নামের তালিকা তৈরি করে। সেরা করদাতার তালিকায় মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্ব স্ব সেক্টরে সর্বোচ্চ আয়কর দেওয়ার পাশাপাশি চলতি কর বছরসহ আগের কমপক্ষে পাঁচ বছরে নিয়মিত করদাতা হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য কালিপদ হালদার বলেন, ‘ট্যাক্স কার্ড দেওয়ার জন্য প্রথমে সেরা করদাতা নির্বাচন করা হয়। আর সেরা করদাতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা আছে। নীতিমালা অনুসরণ করে করদাতাকে মনোনীত করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘নীতিমালাতে যেভাবে বলা আছে, আমরা সেভাবেই সেরা করদাতা নির্বাচন করি।’
- মনোনয়ন পদ্ধতি
প্রতি অর্থ বছরের ১৫ মে’র মধ্যে সব কর কমিশনার বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ট্যাক্স কার্ড পাওয়ার যোগ্য করদাতার প্রাথমিক তালিকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠান। প্রাথমিক তালিকা প্রণয়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেয় এনবিআর।
- ট্যাক্স কার্ড মনোনয়ন কমিটি
প্রতিবছর ট্যাক্স কার্ড মনোনয়নের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সদস্যের (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) নেতৃত্বে একটি “ট্যাক্স কার্ড মনোনয়ন কমিটি” গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ট্যাক্স কার্ড মনোনয়ন দেওয়া হয়। ট্যাক্স কার্ড মনোনয়ন কমিটিতে এনবিআরের সদস্য (কর নীতি), সদস্য (ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট), সদস্য (কর আপিল ও অব্যাহতি), কর কমিশনার, কর অঞ্চল-১, ঢাকা, কর কমিশনার, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ), প্রথম সচিব (কর পরিবীক্ষণ ও প্রশিক্ষণ), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, শুল্ক ও মূসক অনুবিভাগের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি এবং এফবিসিসিআই এর একজন প্রতিনিধি রয়েছেন।
- ট্যাক্স কার্ড মনোনয়নের ক্ষেত্রে যা খতিয়ে দেখা হয়
ট্যাক্স কার্ড দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত করদাতা দণ্ডপ্রাপ্ত বা কোনও ফৌজদারি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কিনা, বা শুল্ক, আবগারি ও মূসক খেলাপী কিনা, বা ঋণ খেলাপী কিনা— এই মর্মে তথ্য সংগ্রহের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক ও মূসক বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি লেখা হয়। চিঠিতে নির্ধারিত তারিখের মধ্যে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করদাতার দণ্ড, ফৌজদারি মামলার চার্জশিটভুক্তি, শুল্ক, আবগারি ও মূসক খেলাপী বা ঋণ খেলাপীর বিষয়ে কোনও তথ্য না পাওয়া গেলে করদাতার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ/দফতরের কোনও বিরূপ মন্তব্য বা আপত্তি নেই বলে বিবেচিত হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ‘ট্যাক্স কার্ড মনোনয়ন কমিটি’র সুপারিশক্রমে ট্যাক্স কার্ড দেওয়ার জন্য করদাতা মনোনয়ন অনুমোদন করে। এছাড়া, তালিকা চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট করদাতার কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত সম্মতি গ্রহণ করা হয় যে,‘ট্যাক্স কার্ড গ্রহণে তার কোনও আপত্তি নাই।’ট্যাক্স কার্ড ও সম্মাননা মনোনীত প্রত্যেক করদাতাকে ট্যাক্স কার্ড এবং সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।
- যেভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়
চলতি কর বছরের আয়কর রিটার্ন ও করারোপনের (সর্বজনীন স্বনির্ধারণী/সাধারণ নিয়মে) আলোকে পরিশোধিত আয়করের ভিত্তিতে বিবেচ্য করদাতাকে ট্যাক্স কার্ডের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর বাইরে আয়ের উৎস বা পেশার ভিত্তিতে ট্যাক্স কার্ডের জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উৎসের আয়কে নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একইভাবে কোম্পানি করদাতাকে ট্যাক্স কার্ডের জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট খাতের আয়কে নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে সরকার বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের পরিশোধিত কর বিবেচ্য প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির পরিশোধিত কর হিসেবে পরিগণিত হবে না। কোনও করদাতার আয়কর মামলা আপিলে বিচারাধীন থাকলে ৭৪ ধারায় পরিশোধকৃত আয়করের ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়া যাবে। কোনও ক্যাটাগরিতে যোগ্য করদাতা না থাকলে অন্য ক্যাটাগরির সম্মিলিত তালিকা হতে ট্যাক্স কার্ডের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়।
- মনোনয়নের অযোগ্য হবেন কারা?
সবচেয়ে বেশি কর দেওয়ার পরও আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর ৭৪ ধারার বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময় সীমার মধ্যে কর পরিশোধে ব্যর্থ হলে তিনি মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। করদাতার কাছে ৭৪ ধারায় প্রদেয় কর বা অবিতর্কিত বকেয়া কর বা চলতি বছরের দাবিকৃত অবিতর্কিত কর পাওনা থাকলে মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। এছাড়া, আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ৯৩ ধারার অধীন করদাতার পুনঃউন্মোচিত অনিষ্পন্ন কোনও কর মামলা থাকলে তিনিও মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। করদাতা কর্তৃক চলতি কর বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিল না করা হলে মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর যেকোনও ধারার অধীনে করদাতার বিরুদ্ধে কার্যক্রম গৃহীত হলে মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। করদাতা কোনও আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর দণ্ড ভোগ করার পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। করদাতা ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ কোনও অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ খেলাপী হলে মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। ট্যাক্স কার্ড মনোনয়ন সংশ্লিষ্ট বছরে করদাতার ঋণ পুনঃতফসিল করা হলে মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। শুল্ক আইন, ১৯৬৯; মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১; এক্সাইজ ও সল্ট অ্যাক্ট, ১৯৪৪ বা দানকর আইন, ১৯৯০ এর আওতায় করদাতার কাছে অবিতর্কিত শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, আবগারি শুল্ক বা দানকর পাওনা থাকলে মনোনয়নের অযোগ্য হবেন। নীতিমালায় বলা আছে, জাতীয়ভাবে ট্যাক্স কার্ড প্রাপ্ত ব্যক্তি জেলাভিত্তিক সেরা করদাতার তালিকায় থাকবে না।
- ট্যাক্স কার্ড প্রাপ্তদের বিশেষ সুবিধা
ট্যাক্স কার্ড প্রাপ্ত ব্যক্তি করদাতা এবং কোম্পানি বা অন্যান্য শ্রেণির করদাতারা ট্যাক্স কার্ডধারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। এছাড়া, বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় আমন্ত্রণ পাবেন। যেকোনও ভ্রমণে বিমান, রেলপথ ও জলপথে সরকারি যানবাহনে টিকিট প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবেন। ট্যাক্স কার্ডধারীর স্ত্রী/স্বামী, নির্ভরশীল ছেলেমেয়ে ও নিজের চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের কেবিন সুবিধা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবেন। বিমানবন্দরে সিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুবিধা পাবেন। তারকা হোটেলসহ সব আবাসিক হোটেলে বুকিং প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাবেন।
- ট্যাক্স কার্ডের মেয়াদ ও ব্যবহার
ট্যাক্স কার্ড ইস্যুর তারিখ হতে পরবর্তী একবছর পর্যন্ত কার্ডের মেয়াদ ও সুবিধাদি বহাল থাকবে। ট্যাক্স কার্ডের মেয়াদকাল উত্তীর্ণ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে করদাতা কর্তৃক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে জমা দিতে হবে। মেয়াদকাল উত্তীর্ণ হওয়ার পর ট্যাক্স কার্ডের জন্য প্রদত্ত সুবিধা বহাল থাকবে না। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কারণ উল্লেখপূর্বক প্রদত্ত ট্যাক্স কার্ড প্রত্যাহার করতে পারবে।
এবার ব্যক্তি পর্যায়ে ৭৪ জনের মধ্যে পাঁচ জন সিনিয়র নাগরিক, তিন জন গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, তিন জন প্রতিবন্ধী, পাঁচ জন নারী করদাতা ও পাঁচ জন তরুণ করদাতা (৪০ বছরের কম বয়সী) ট্যাক্স কার্ড পেয়েছেন। এছাড়া আয়ের উৎস হিসেবে পাঁচ জন ব্যবসায়ী, পাঁচ জন বেতনভোগী, পাঁচ জন চিকিৎসক, পাঁচ জন সাংবাদিক, পাঁচ জন আইনজীবী, তিন জন প্রকৌশলী, তিন জন স্থপতি, তিন জন অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সাত জন নতুন করদাতা, তিন জন খেলোয়াড়, তিন জন অভিনেতা-অভিনেত্রী, তিন জন শিল্পী-গায়িকা এবং অন্যান্য তিন জন এই কার্ড পেয়েছেন।
আর কোম্পানি পর্যায়ে ৫৭টির মধ্যে ব্যাংক খাতে ৮টি, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতে চারটি, একটি টেলিকমিউনিকেশনে, তিনটি প্রকৌশলে, তিনটি খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে, তিনটি জ্বালানিতে, তিনটি পাটে, সাতটি স্পিনিং ও টেক্সটাইল, চারটি ওষুধে, চারটি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, তিনটি রিয়েল এস্টেটে, সাতটি তৈরি পোশাকশিল্পে, তিনটি চামড়াশিল্পে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে চারটি কার্ড দেওয়া হবে। অন্যান্য ক্যাটাগরির ১০ জনের মধ্যে চারটি ফার্মে, একটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষে, দুটি ব্যক্তিসংঘে এবং অন্যান্য খাতে তিনটি ট্যাক্স কার্ড পেতে যাচ্ছেন। সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন/গোলাম মওলা