মঈদুল ইসলাম:
অধ্যাদেশের পরিণতি সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি এবং এ নিয়ে কোন বিতর্কও দেখা যায় না। কিন্তু, অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত বিধানাবলির পরিণতি সম্পর্কে শুধু বিতর্কই নয় রীতিমত বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়টি (2016) 68 DLR (AD) 118 পৃষ্ঠায় Moudud Ahmed vs State মামলার আগে আমাদের দেশে কখনও উত্থাপিত হয়নি সুপ্রিমকোর্টে এবং কোন সিদ্ধান্তও ছিলনা এ বিষয়ে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট (1985) 3 SCC 198 পৃষ্ঠায় Venkata Reddy T vs State of AP মামলায় অনেক আগেই এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, সংশোধনকারী অধ্যাদেশটির কার্যকরতালোপ পেলেও ঐ অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত বিধানাবলি মুছে গিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনটি পূর্বাবস্থায় আর ফিরে আসেনা আপনা-আপনি। আমাদের সংবিধানের ৯৩(২) অনুচ্ছেদের অনুরূপ বিধানই রয়েছে ভারতের সংবিধানে ২১৩(২) অনুচ্ছেদে। আমাদের আপীল বিভাগ 68 DLR (AD) 118 পৃষ্ঠায় Moudud Ahmed vs State মামলায় “The failure of the Parliament to pass an Act in terms of the amending Ordinance No.VII of 2007 do not destroy/repeal amendments which have already been incorporated in the ACC Act, 2004” বলে পরিষ্কার করে সিদ্ধান্ত দেবার পরও কেন যেন ঘোর কাটছেনা অনেকের। আইনের বই এখনও ছাপান হচ্ছে ঐসব সংশোধিত বিধানাবলি বাদ রেখে, আইনের ওয়েবসাইটগুলোতেও ঐসব সংশোধিত বিধানাবলি বাদ রেখেই সংশোধন পূর্বাবস্থায় আপলোড করা হচ্ছে বিভিন্ন আইন। ছড়াচ্ছে এবং বাড়াচ্ছে বিভ্রান্তি।
আমাদের সংবিধানের ৯৩(২) অনুচ্ছেদের মোদ্দা কথা হল, অধ্যাদেশ জারীর পর অনুষ্ঠিত সংসদের প্রথম বৈঠকে তা উপস্থাপন করতে ইহবে; আর, সেইদিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সংসদ যদি তা অনুমোদন না করে তাহলে ঐ ৩০ দিনের পরদিন থেকে ঐ অধ্যাদেশের কার্যকরতা আপনা-আপনিই লোপ পাবে। কিন্তু, আমাদের আলোচ্য হল সংশোধনকারী অধ্যাদেশ যার দ্বারা পূর্ব থেকেই প্রচলিত কোন আইনের বিধানাদি সংশোধন করা হয় সংযোজন, সন্নিবেশ, প্রতিস্থাপন, বিলোপ বা রহিত করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ধরনের অধ্যাদেশের কার্যকরতাও ৯৩ (২) অনুচ্ছেদ দ্বারাই নির্ধারিত। অর্থাৎ, সংসদ অনুমোদন না করলে সেই ৩০ দিনের পরদিন থেকে কার্যকরতা লোপ পাবে। কিন্তু, সংশোধনকারী অধ্যাদেশ যেদিন কার্যকর হয় সেদিনই তার উদ্দেশ্য অর্থাৎ, সংশোধনের কাজটি সমাধা হয়ে যায়; তারপরে আর এর কার্যকর করার কিছুই থাকেনা – প্রয়োজনীয়তা, উপযোগীতা সবই ফুরিয়ে যায়। তাই, সংশোধনকারী আইনগুলো সময়ে সময়ে রহিত করে আইনের সংকলন জঞ্জালমুক্ত করে সাফ-সুতরা (Spring-cleaning) করা হয়ে থাকে। এই ধরনের রহিত আইনগুলোকে ইংল্যান্ডে “Statute Law Revision Act” বলা হয়।
আমাদের আলোচ্য হল এই সংশোধনকারী অধ্যাদেশ দ্বারা যেসব বিধানাবলির সংশোধন সাধিত হয়ে যায় সেসবের পরিণতি অর্থাৎ, অধ্যাদেশের কার্যকরতা লোপ পাওয়া মাত্রই অধ্যাদেশ দ্বারা পূর্বে সাধিত সংশোধনীগুলোও আপনা-আপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, নাকি অক্ষত হিসেবে বিদ্যমান ও কার্যকর থাকবে! এ কথায় তো বিতর্ক নেই যে, কোন আইন বা আইনের কোন বিধান পরবর্তীতে কখনও বিলোপ বা রহিত হলেও ঐ আইন বা আইনের ঐ বিধানবলে পূর্বে সাধিত কোন কার্যই বাতিল হয়ে যায়না। আইন ব্যাখ্যার আইন “The General Clauses Act, 1897” এর ধারা ৬ সে কথাই বলে–
“Effect of repeal.- Where this Act, or any Act of Parliament or Regulation made after the commencement of this Act, repeals any enactment hitherto made or hereafter to be made, then, unless a different intention appears, the repeal shall not –
- revive anything not in force or existing at the time at which the repeal takes effect; or
- affect the previous operation of any enactment so repealed or anything duly done or suffered thereunder; or
- affect any right, privilege, obligation or liability acquired, accrued or incurred under any enactment so repealed; or
- affect any penalty, forfeiture, or punishment incurred in respect of any offence committed against any enactment so repealed; or
- affect any investigation, legal proceeding or remedy in respect of any such right, privilege, obligation, liability, penalty, forfeiture or punishment as aforesaid;
and any such investigation, legal proceeding or remedy may be instituted, continued or enforced, and any such penalty, forfeiture or punishment may be imposed as if the repealing Act or regulation had not been passed.” (গুরুত্ব বোঝাতে আন্ডার লাইন দেয়া হল)
দেখুন, কোন আইন দ্বারা কোন আইন রহিত হলেও রহিতকৃত আইনের অধীনে সাধিত কোন কিছুই ক্ষুণ্ন হয়না, বরং, রহিতকৃত আইন বহাল থাকাকালে সৃষ্ট অধিকার, দায়-দায়িত্ব, প্রদত্ত সাজা, সবই বহাল থাকে – এমনকি, রহিতকৃত আইন বহাল থাকালে সংঘটনকৃত অপরাধের জন্য পরবর্তীকালে বিচারে সোপর্দ করা যায়, বিচারও করা যায়। তাহলে, অধ্যাদেশ দ্বারা সাধিত সংশোধনীর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে কেন? কেন সাধিত সংশোধনীগুলো অক্ষুণ্ন থাকবে না? কেনইবা সেসব বিলুপ্ত হয়ে যাবে আপনা-আপনি? সংবিধানের ৯৩(২) অনুচ্ছেদে তো শুধু অধ্যাদেশটির কার্যকরতা লোপের কথা বলা হয়েছে, অধ্যাদেশের অধীনে সাধিত সংশোধনী বা কোন কাজ লোপের বা বাতিলের কথা তো বলা হয়নি।
যে আইন দ্বারা কোন আইন সংশোধন হয় সেই সংশোধনকারী আইন পরবর্তীকালে রহিত হলে তার অধীনে পূর্বে সাধিত সংশোধনীগুলোর কী পরিণতি হবে তার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে “The General Clauses Act, 1897” এর ধারা 6Aতে –
“Repeal of Act making textual amendment in Act or Regulation.-Where any Act of Parliament or Regulation made after the commencement of this Act repeals any enactment by which the text of any Act of Parliament or Regulation was amended by the express omission, insertion or substitution of any matter, then, unless a different intention appears, the repeal shall not affect the continuance of any such amendment made by the enactment so repealed and in-operation at the time of such repeal.” (গুরুত্ব বোঝাতে আন্ডার লাইন দেয়া হল)
দেখুন, এখানে সুস্পষ্ট বিধান হল – সংশোধনকারী আইন রহিতের ফলে রহিতকৃত আইনের অধীনে সাধিত কোন সংশোধনীর কার্যকরতা, বিদ্যমান তা ক্ষুণ্ন হবেনা এবং রহিতকালে যা কার্যকর ছিলনা তারও কোন অবস্থান্তর হবে না অর্থাৎ, যা ছিলনা তা আর ফিরে আসবে না।
এখন প্রশ্ন যদি হয়, General Clauses Act- এর ধারা 6A-এর এই বিধান অধ্যাদেশের বেলায় প্রযোজ্য হবে কিনা! তাহলে দেখুন,General Clauses Act-এর ধারা ৩০-এর বিধান –
“Application of Act to Ordinances. In this Act the expression Act of Parliament wherever it occurs, except in section 5, and the word “Act” in clauses (9), (12), (38), (48) and (50) of section 3 and in section 25 shall be deemed to include an Ordinance made and promulgated by any person having authority to legislate under any constitutional provision or by the President of Bangladesh under the Constitution.” (গুরুত্ব বোঝাতে আন্ডার লাইন দেয়া হল)
তাহলে, ধারা 6A-তে উল্লিখিত Act of Parliament অর্থাৎ, সংসদের আইন বলতে অধ্যাদেশকেও বোঝায়। আর কি কোন সন্দেহ আছে যে, ধারা 6A-এর ঐ বিধান অধ্যাদেশের বেলায়ও প্রযোজ্য! তাহলে, সংশোধনকারী অধ্যাদেশ রহিত হলেই তার অধীনে সাধিত সংশোধনীগুলোর কার্যকরতা ক্ষুণ্ন হবার বা এই রহিতকালে যা কার্যকর ছিলনা তা আবার পুনর্বহাল হয়ে যাবার কোন সুযোগ থাকেনা।
এবার যদি বলেন, সংশোধনকারী অধ্যাদেশ রহিতের ক্ষেত্রে না হয় মেনে নেয়া গেল কিন্তু, সংবিধানের ৯৩(২) অনুচ্ছেদ বলে কার্যকরতা লোপ পাওয়া সংশোধনকারী অধ্যাদেশের ক্ষেত্রে কী হবে? দেখা যাক, সংবিধানের ১৫২(২) অনুচ্ছেদ –
“১৫২(২) ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস আ্যক্ট
(ক) সংসদের কোন আইনের ক্ষেত্রে যেরূপ প্রযোজ্য, এই সংবিধানের ক্ষেত্রে সেইরূপ প্রযোজ্য হইবে;
(খ) সংসদের কোন আইন দ্বারা রহিত কোন আইনের ক্ষেত্রে যেরূপ প্রযোজ্য, এই সংবিধানের দ্বারা রহিত কিংবা এই সংবিধানের কারণে বাতিল বা কার্যকরতালুপ্ত কোন আইনের ক্ষেত্রে সেইরূপ প্রযোজ্য হইবে।” (গুরুত্ব বোঝাতে আন্ডার লাইন দেয়া হল)
তাহলে দেখুন, সংবিধানের ৯৩(২) অনুচ্ছেদবলে কার্যকরতালুপ্ত অধ্যাদেশের ক্ষেত্রেও General Clauses Act-এর ধারা ৬ ও 6A-এর বিধানাবলিই প্রযোজ্য, সেকথা সংবিধানেই বলা আছে। আইন বলতে যে অধ্যাদেশকেও বোঝায় সেকথাও তো সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদের প্রথমদিকেই বলা আছে।
কোন অধ্যাদেশ (বা আইন) সুপ্রিম কোর্ট বাতিল (Void ab initio) ঘোষণা করলে ঐ অধ্যাদেশ আদৌ ছিলনা বলে গণ্য হয় এবং সেক্ষেত্রে ঐ অধ্যাদেশ পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরে আসবার কথা হতে পারে। কিন্তু, বাতিল ঘোষণা হওয়া আর কার্যকরতালুপ্ত হওয়া তো এক কথা নয়। এখানে যারা গুলিয়ে ফেলেছেন তারাই এ বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। বাতিল হলে যে পরিণতি কার্যকরতালুপ্ত হলেও সেই একই পরিণতি তো হতে পারে না। কার্যকরতালুপ্ত হবার আগেরদিন পর্যন্ত তো তা বৈধভাবেই কার্যকর ছিল এবং কার্যকর থাকাকালে ঐ অধ্যাদেশের অধীনে যা কিছু করা হয়ে গেছে সেসবও বৈধ। তাই, সংশোধনকারী অধ্যাদেশ দ্বারা যেসব বিধানাবলির সংশোধন সাধিত হয়ে যায় সেই অধ্যাদেশের কার্যকরতা সংবিধানের ৯৩(২) অনুচ্ছেদ বলে লোপ পেলেও পূর্বেই সাধিত সংশোধনীগুলো আপনা-আপনি মুছেও যাবেনা বা পূর্বের বিধান ফিরেও আসবে না, অক্ষত হিসেবে বিদ্যমান ও কার্যকর থাকে – নতুন কোন আইনে ঐসব বিধানাবলি রহিত না করা পর্যন্ত। এ কথা যেমন দুদক আইনের ১৮ ধারার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য একই অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত দুদক আইনের ২১ ও ৩৪ক ধারার ক্ষেত্রেও। এ কথা প্রযোজ্য ঐ একই সময়ে ভিন্ন অধ্যাদেশ বলে সংশোধিত Criminal Law Amendment Act, 1958-এর 6A ধারা ও Special Powers Act, 1974-এর ১৬ ধারা এবং এরকম অন্যান্য আইনের বিধানাবলির ক্ষেত্রেও।
আশাকরি, আইনের এই অবস্থা উপলব্ধি করে আইনের লেখকগণ আর ওয়েবসাইটগুলোর কর্তৃপক্ষ তাদের প্রকাশনাগুলো শুধরে নেবেন, ব্যতিক্রম হলে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা দেবেন, আইন অঙ্গনের সবাই আইনের সঠিক প্রয়োগ করবেন।
লেখক: সাবেক সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক। e-mail: moyeedislam@yahoo.com