উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ১২৬ মামলার তদন্ত করতে পারছে না পুলিশ। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, বোমা হামলা, জালিয়াতিসহ সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের গুরুতর অপরাধের ঘটনায় হওয়া এসব মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। এগুলোর মধ্যে বহুল আলোচিত যশোর উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সম্মেলনে বোমা হামলার মামলাও রয়েছে।
পুলিশ বলছে, সিআইডিতে মামলা আসার পরপরই তদন্ত বন্ধ রাখতে আসামিপক্ষ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেয়। স্থগিতাদেশ থাকায় এসব মামলার তদন্তকাজ থেমে আছে। রাষ্ট্রপক্ষ এসব মামলা সুরাহায় কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
আর ভুক্তভোগীরা বলছেন, বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকায় তাঁরা বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পরিবারে বাড়ছে হতাশা। সরকারের কাছে তাঁরা ন্যায়বিচারের দাবি জানান।
এসব মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান কৌঁসুলি মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এতগুলো মামলার স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে, তা জানি না।’ কোন মামলা, কোথাকার মামলা—এসব তথ্য জানতে পারলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
সিআইডি সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুন মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীসহ সারা দেশের ১৫ অঞ্চলে ভাগ হওয়া এ ধরনের মামলার সংখ্যা ১২৬। এর মধ্যে সিআইডির ঢাকা মহানগর উত্তরে ১৭টি, ঢাকা মহানগর পশ্চিমে ১৭টি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণে ৯টি, ঢাকা মহানগর পূর্বে ১১টি, ঢাকা জেলায় ৪টি, ফরিদপুরে ৪টি, চট্টগ্রামে ১৩টি, সিলেটে ৬টি, খুলনায় ১০টি, যশোরে ৬টি, বরিশালে ৫টি, রাজশাহীতে ৬টি, রংপুরে ৩টি, কুমিল্লায় ১টি, ময়মনসিংহে ৭টি ও অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগে ৭টি মামলা রয়েছে।
জানতে চাইলে সিআইডির উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অর্গানাইজড ক্রাইম) ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১২৬ মামলায় তদন্তকাজ পরিচালনায় স্থিতাবস্থা রয়েছে। এ কারণে মামলার তদন্তকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, ১৯৮৯ সালের ২১ জুলাই হবিগঞ্জের চুনারুঘাট শালবনের কাছে সাত বছর বয়সী শিশু জয়নুবুন নাহারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় শিশুটির সৎভাই নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চুনারুঘাট থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্তভার পায় সিআইডি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক বলেন, পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মামলার বাদী নুরুল ইসলামসহ চারজন মিলে সম্পত্তির লোভে শিশুটিকে কুপিয়ে হত্যা করেন। পুলিশ ওই চারজনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। নুরুল ইসলামের লোকজন বুঝতে পারেন, তাঁদের সাজা হবে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯৮ সালের ৯ মার্চ হাইকোর্ট থেকে ওই মামলার স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন তাঁরা। এরপর থেকে মামলাটির বিচার কার্যক্রম থেমে আছে। মামলাটির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে একাধিকবার অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে আবেদন করেছিলেন আবদুর রাজ্জাক।
যশোর টাউন হল মাঠে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সম্মেলনে বোমা হামলা মামলার তিন আসামি ২০১৫ সালে হাইকোর্ট থেকে মামলার স্থগিতাদেশ নেন। সেই থেকে মামলার কার্যক্রম থেমে আছে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে শক্তিশালী ওই বোমা হামলা চালানো হয়। দেশের প্রথম জঙ্গি হামলা হয় ওই অনুষ্ঠানেই। এতে শিল্পীসহ ১০ জন নিহত এবং দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন।
মামলাটির বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে যশোর আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রফিকুল ইসলাম বলেন, মামলার সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়ার পর আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ২০১১ সালে উচ্চ আদালতে আপিল আবেদন করে। ওই আপিলের ওপর চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষা করা হচ্ছে। সরকার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করলে উচ্চ আদালত আপিল আবেদন গ্রহণ করেন এবং আসামিদের যশোরের নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। মামলার ২৩ আসামির মধ্যে ১৯ জন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। অপর চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এখন জামিন নেওয়া আসামিরা হাজিরা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, দেশজুড়ে আলোচিত এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।
উদীচী ট্র্যাজেডিতে পা হারানো সুকান্ত দাস বলেন, ঘটনা ঘটেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। মামলাটা এখন ধামাচাপা পড়ে গেছে। উদীচীসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সদস্যদের ও ভুক্তভোগী সবার একটাই চাওয়া—প্রকৃত আসামিদের ধরে বিচার করা।
২০০৯ সালে গুলশান এলাকার একটি বাড়ির সানশেড থেকে সারা শরীরে জখম অবস্থায় আবাসন ব্যবসায়ী মোহাইমিনুল বারীকে নামিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় মোহাইমিনুলের বাবা গুলশান থানায় করা মামলায় অভিযোগ করেন, তারানা জামান ও শারমিন ফারহানা নামের দুই নারী মোহামিনুলকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক রেজাউল করিম বলেন, তদন্ত শেষে গুলশান থানার পুলিশ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা না পেয়ে দুই আসামিকে বাদ দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু বাদী নারাজি আবেদন করলে আদালত মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০১৫ সালে আসামি তারানা জামান উচ্চ আদালতে আবেদন করে ওই মামলায় স্থগিতাদেশ নেন।
সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) মামলাগুলোর শুনানির উদ্যোগ নিতে হবে। এটা না করলে বিচারপ্রার্থীরা বিচার পাবেন না। ভয়াবহ অপরাধের শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে বিচার পাইয়ে দিতে রাষ্ট্রপক্ষকে দায়িত্ব নিতে হবে। সূত্র- প্রথম আলো