আদালতের সময়ের সঠিক ব্যবহারের দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘আদালতের সময়ের সঙ্গে নো কমপ্রোমাইজ। কারণ কোর্টে থাকলেই কাজ হবে, মামলার নিষ্পত্তি (ডিসপোজাল) বাড়বে। আর সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সব আদালতেই মামলার ট্রায়াল (বিচার) হবে। দুপুর ২টার পরে জামিন আবেদন ও বিবিধ বিষয়ের শুনানি করতে হবে।’ এই নির্দেশনা না মানলে কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলেও জানান প্রধান বিচারপতি।
বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে কর্ম অধিবেশনে শনিবার (৭ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি দিকনির্দেশনামূলক এই বক্তব্য দেন।
অধিবেশনে আপিল বিভাগের সব বিচারপতিই বক্তব্য দেন। এ ছাড়া ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মো. হেলাল চৌধুরীসহ সাতজন জেলা ও দায়রা জজ অধস্তন আদালতের বিচারকদের সব সমস্যা তুলে ধরেন কর্ম অধিবেশনে। এরপর প্রধান বিচারপতি তাদের সমস্যাসমূহ সমাধানে আশ্বস্ত করেন। এ অধিবেশনে সারা দেশের বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে প্রথম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন এই সম্মেলনের প্রধান অতিথি।
এই অধিবেশনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি প্রথমে আসব কোর্টের টাইমিংয়ের (আদালতের সময় ব্যবহারের) ওপরে। আমি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরে, দেখলাম যে নিম্ন আদালতের বিচারকরা কীভাবে কাজ করছেন। আমি আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে ১১জন জেলা জজকে ফোন করলাম। তার মধ্যে নয়জনকে পেলাম চেম্বারে। প্রশ্ন করলাম কী করেন আপনি চেম্বারে। বলল, স্যার এইতো, এইমাত্র এজলাস থেকে নেমেছি। কোর্টের টাইম তো পাবলিক টাইম (জনগণের সময়)। তারপর সব জুডিশিয়াল অফিসাররা তো আমার সাথে থাকেন, অনেকে বলল স্যার দেখবেন, ঢাকার একটি যুগ্ম জেলা জজ এত ব্যস্ত তাকে অবশ্যই কোর্টে পাবেন। ফোন দিলাম একজন যুগ্ম জেলা জজকে, বলল স্যার আমি তো চেম্বারে। এই মাত্র নেমেছি।’
সঠিক সময়ে এজলাসে ওঠা ও নামার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা যারা আপিল বিভাগে বসি, ঠিক নয়টায় বসি। আমরা এক মিনিট সময় নষ্ট করি না। প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিরা যদি সময়মতো কোর্টে ওঠে, সময়মতো নামে, তাহলে অন্যান্য কোর্টের জজ সাহেবরা কেন সময়মতো কোর্টে উঠবে ও নামবে না। সুতারাং কোর্টে ওঠা ও নাম আমি স্ট্রিকলি (কঠোরভাবে) ফলো করতে চাই। এজন্য কিছু একটা পরিবর্তন করছি, বিকেলে অ্যাডভোকেট সাহেবরা আদালতে থাকতে চান না, সে কারণে বলেছি দুপুরে বেইল মেটার (জামিনের বিষয়) ও মিসসিলেনিয়াস মেটার (বিবিধ বিষয়) শুনতে হবে। আর সকালে বিচার করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিচারের (ট্রায়ালের) অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ট্রায়াল হচ্ছে না কোথাও। হাজার হাজার মামলা জমে যাচ্ছে। সকালে ট্রায়াল হলে আর বিকেলে মিসসিলেনিয়াস মেটার ও বেইল মেটার হলে রাত ১০টায়ও যদি শুনানি করেন, দেখবেন যে আপনার কোর্ট ভর্তি আইনজীবী থাকবে। একজনও অনুপস্থিত থাকবেন না।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সুতারাং আমি ঠিক করেছি বিকেলে ২টার পরে বেইল মেটার ও জামিন মেটার শুনতে হবে। আইনজীবী সমিতি থেকে অনেক অভিযোগ, যে স্যার আমাদের ২টার পরে থাকতে কষ্ট হয়, আমি বললাম আমাদের এখানে সবচেয়ে সিনিয়র মোস্ট অ্যাডভোকেট ছিলেন টিএইচ খান। আমি চেম্বার জজ ছিলাম অনেক বছর, তখন দেখেছি এই ৯৫ বছর বয়সী মানুষটি আমার কোর্টে এসেছে ৪টার সময়। সুতারাং বয়স কোনো ফ্যাক্টর না। বয়স বেশি হলে আরও বেশি কাজ করবেন। বয়স যত বেশি হবে, যত বেশি কাজ করবেন, তত বেশি ভালো থাকবেন।’
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে আদালতের টাইমিংয়ের বিষয়ে পাঠানোর বিষয়টি স্মরণ করিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখনো অনেক জায়গায় সকালে বেইল মেটার শুনছেন। আমি কিন্তু সামনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেব। আমি এটা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করব। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেও আপনার সকাল বেলা বেইল পিটিশন শোনেন। আমি বলেছি এখন থেকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টেও বিকেলে বেইল পিটিশন শুনবে। দুইটার আগে সমস্ত আদালতে ট্রায়াল হবে। এটা কিন্তু আমার আদালত থেকে নোটিশ পাঠানোর পরে টেলিফোন করে দেখেছি এটা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমি সাতজনকে টেলিফোন করেছি, তার মধ্যে আমি তিনজনকে চেম্বারে পেয়েছি, আড়াইটার সময়। প্রধান বিচারপতির কথাও যদি না শোনেন, আমি কিন্তু কঠোর হস্তে এটা নিয়ন্ত্রণ করব। কোনো ছাড় দেব না। আমি আপনাদেরকে বলছি, কোর্টের সময়ের সঙ্গে নো কমপ্রোমাইজ। কারণ কোর্টে থাকলেই কাজ হবে, নিষ্পত্তি (ডিসপোজাল) বাড়বে।’
সাক্ষী আসলে ফেরত না দিয়ে সাক্ষ্য নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোর্টে সাক্ষী হাজিরা দিলে রাত ১০টাও যদি বাজে, সাক্ষ্য গ্রহণ করেই তাদেরকে ছাড়বেন। কারণ, ফৌজদারি মামলায় সাক্ষী পাওয়া কঠিন। কয়েকদিন আগে একটি সেমিনারে গিয়েছি, সেমিনারে বলল যে, মানব পাচারের অনেক মামলা ১০ থেকে ১২ বছর ধরে পেন্ডিং (বিচারাধীন)। এটা কী কারণে হচ্ছে না। ১০ থেকে ১২ বছর ধরে মামলা পেন্ডিং থাকে-এটা মানুষ যদি শোনে, বিচার বিভাগ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা হবে। সুতারাং ১২ বছর, ১০ বছর ধরে একটা মামলা কেন পেন্ডিং, সেটা আমাকে জানান। হাইকোর্টে যদি সেটা স্টে থাকে, আমি নিজেই পদক্ষেপ নেব, ওই মামলা বিশেষ কোর্টে প্রেরণ করব, তাড়াতাড়ি যাতে নিষ্পত্তি হয়।’
রিক্রিয়েশন লিভ ছুটির সময় নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘আগে বন্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে রিক্রেয়শন লিভ নিত, এখন বন্ধের সময় কেউ রিক্রিয়েশন লিভ নেয় না। এভাবে কাজ করলে মামলার পাহাড় জমে যাবে। মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব না যে, যখনই ছুটি চাইবে, মিনিস্ট্রি এটা পাঠিয়ে দেবে। মিনিস্ট্রিরও একটা স্ক্রুটিনি থাকা দরকার। মিনিস্ট্রি কোনো পোস্ট বক্স না।’
অনুষ্ঠানে তিনি সহকারী জজদের স্টেনোগ্রাফার, রেস্ট হাউজের সমস্যার সমাধান করা হবে বলে জানান। এ ছাড়া বিচারকদের জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যে কোনো সময় ছুটি নেয়নি, তার জন্যে একটা পুরস্কার থাকবে। যে হায়েস্ট ডিসপোজাল (সবচেয়ে বেশি মামলা নিষ্পত্তি) করবে তার একটা পুরস্কার থাকবে। এটা প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি যে থাকবেন তার হাত থেকে পুরস্কার নেবে। আর একটা পুরস্কার থাকবে বেস্ট ডিসট্রিক্ট জজ (ভালো জেলা জজ)। সুতারাং আপনারা যারা আগামীতে ঠিকভাবে কাজ করবেন, তারা পুরস্কৃত হবেন- এ ব্যাপারে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি।’