‘বাংলাদেশের সোনার মেয়ে ইতি…’ সত্যিই তো সোনার মেয়ে। গতকাল মেয়েদের রিকার্ভে মেয়েদের দলগত ও মিশ্র দলগত ইভেন্টে সোনা জিতেছেন। আজ একটা রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে খেলতে নেমেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পেরেছেন ইতি। রিকার্ভ মেয়েদের এককের ফাইনালে ভুটানের কিনলে শেরিংকে ৭-৩ সেট পয়েন্টে হারিয়ে জেতেন সোনা। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে নিজেকে চিনিয়েছেন ইতি। এ বছর জাতীয় জুনিয়রে রিকার্ভেও ব্যক্তিগত ইভেন্টে জেতেন রুপা, জুনিয়র ক্যাডেট বিভাগে জেতেন সোনা।
বাংলাদেশের এসএ গেমসের ৩৫ বছরের ইতিহাসে এর আগে কোনো নারী খেলোয়াড় একই গেমসে তিনটি সোনা জিততে পারেননি। আজ পোখারার অন্নপূর্ণার কোলে দাঁড়িয়ে যে ইতিহাস লিখলেন ইতি।
এর আগে একই গেমসে সর্বোচ্চ সোনার পদক জেতেন সাঁতারু সেই ১৯৮৫ সালে ঢাকায় এসএ গেমসে সুইমিংপুলে রীতিমতো ঝড় তোলেন মোশাররফ হোসেন খান। সেবার বাংলাদেশ জেতে ৯টা সোনা। এর মধ্যে ৬টা সোনা এসেছিল সাঁতার থেকে। আর গেমসে একাই ৫টি সোনা জেতেন সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান। তিনি তিনটি ব্যক্তিগত ও রিলেতে দুটি সোনা জিতেছিলেন।
এমন রেকর্ডেও কথা জানতেন না ইতি। কাল এক সাংবাদিক বিষয়টা মনে করিয়ে দিতেই বলছিলেন, ‘আমি এটা জানার পর আরও বেশি করে চেষ্টা করেছি যেন এই সোনার পদকটাও জিততে পারি। শেষ পর্যন্ত পেরেছি, এ জন্য ভালো লাগছে।’
দুশ্চিন্তায় ভালো ঘুম হয়নি গত রাতে, ‘গত রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনি। এত দিন কিছু নিয়ে টেনশন করিনি। কিন্তু কাল ঘুমাতে পারিনি। মনে হচ্ছিল ঘুমের ঘোরেও কাঁপছি। এরপর সকালে একটু স্বাভাবিক হয়ে অনুশীলন করেছি।’
বিস্ময়ের ঘোর ছিল ইতির কণ্ঠে, ‘আমি ভাবতেও পারিনি এ পর্যন্ত আসতে পারব। আমার মা–বাবা শুরুতে চাইতেন না আর্চারি খেলি। কিন্তু ভালো করার পর ওনারা সহায়তা দেন। এমনকি আমার স্কুলের ম্যাডাম পর্যন্ত কাল ফোন দিয়েছেন। আমি খুব খুশি।’
বাংলাদেশের আর্চারির ইতিহাসে এই বিস্ময়বালিকার আজ হয়তো এখানে আসাই হতো না। আর্চারিতে না এলে কোনো এক গ্রামে ঘরকন্নায় ব্যস্ত থাকতেন এত দিন।
কতইবা বয়স হবে তখন? ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন ইতি খাতুন। পাড়ার সাথিদের সঙ্গে পুতুল খেলেই সময়টা কেটে যেত বেশ। আরও একটা খেলার প্রতি ভীষণ টান ছিল ইতির। তির-ধনুকের খেলায় এতটাই মজে গিয়েছিলেন যে মা–বাবার বকুনিকেও পরোয়া করতেন না। অনুশীলন শেষে একদিন বাড়িতে এসে দেখেন, বাবা তাঁকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। পাত্রপক্ষ বসা বাড়ির বারান্দায়। বিয়ের সব আয়োজন শেষ।
শাড়ি পরে ঘোমটা মাথায় পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ান ইতি। পাত্রপক্ষের পছন্দও হয়ে যায় ‘বালিকা বধূকে’ দেখে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন ইতি। বিয়েটা আর হয়নি। বিয়ের আসর থেকে উঠে আসা মেয়েটাই এবারের দক্ষিণ এশিয়ান গেমস মাতাচ্ছেন।
তির নবম জাতীয় আর্চারিতে ২০১৮ সালে জেতেন প্রথম পদক। তিরন্দাজ সংসদের হয়ে মেয়েদের রিকার্ভ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জেতেন চুয়াডাঙ্গার কিশোরী। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) প্রতিভা অন্বেষণের আবিষ্কার ইতি। চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে আর্চারির প্রাথমিক বাছাইয়ে হয়েছিলেন প্রথম। চুয়াডাঙ্গার ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী প্রথমবার আন্তর্জাতিক আসরে সুযোগ পেয়েই জ্বলে উঠলেন।
বাবা ইবাদত আলী হোটেলের কর্মচারী। তিন মেয়ে ইভা খাতুন, ইতি খাতুন ও স্মৃতি খাতুনকে নিয়ে সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। মেয়েদের স্কুলের খরচ জোগাতে পারেন না বেশির ভাগ সময়। তাই তো মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল, সেটা পরে স্বীকার করেন।
বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে অনেক আগেই একটা যুদ্ধে জিতে গেছেন ইতি। মাঠের লড়াইয়ে একের পর এক জিতে এবার নাম লেখালেন ইতিহাসে। সূত্র: প্রথম আলো