ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ:
আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলা নিয়ে আমাদের উৎসাহ থাকা স্বাভাবিক। কারণ প্রায় বারো লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিজ ভূমিতে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বেশ বিপাকেই পড়েছে। নানা কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে বিশ্বজুড়ে তাদের প্রত্যাবসন নিয়ে। কিন্তু, সেই অর্থে সফল আমরা হতে পারিনি। আর তাই আমাদের বিশাল স্বপ্ন যে আইসিজেতে একটা কিছু হয়ে গেলেই মনে হয় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবে। আসলেই কি তাই? আবেগের জায়গা রয়েছে বটে এই শুনানী নিয়ে। কিন্তু আসলেই বাংলাদেশ এই শুনানী থেকে কি পেতে চলেছে?
(১) রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বীকৃতি? মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে বলে গাম্বিয়া শুনানীর প্রথম দিন বিশদ তথ্যগত দৃষ্টান্ত আইসিজে আদালতের সামনে উপস্থাপন করেছে। যদিও শুনানীর দ্বিতীয় দিন মিয়ানমারের পক্ষে বিশ্ববিখ্যাত গণহত্যা-আইন বিশারদ প্রফেসর উইলিয়াম শাবাস তার দীর্ঘ সাবমিশনে আইনী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন যে, গাম্বিয়া তার প্রথম দিনের সাবমিশনে মিয়ানমারে সংঘটিত ঘটনাবলীকে “গণহত্যা” হিসেবে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে কারণ তারা গণহত্যা অপরাধ প্রমাণের অন্যতম একটি উপাদান “জেনোসাইডাল ইনটেন্ট” প্রমাণে তেমন কোন আইনী যুক্তি তুলে ধরতে পারেনি।
প্রফেসর উইলিয়াম শাবাস তার যুক্তির পক্ষে উদাহরণ হিসেবে আইসিজেতে বর্তমানে চলমান “ইউক্রেন বনাম রাশিয়া” মামলায় ইতিমধ্যে গৃহীত কিছু সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরেন। তিনি যুক্তি দেন যে, মিয়ানমারে সংঘটিত অপরাধ সমুহকে যদি “গণহত্যা” হিসেবে প্রমাণ করতে হয় তবে গাম্বিয়াকে দেখাতে হবে যে, সেসব সংঘটনের পেছনে মিয়ানমার রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট ‘knowledge’ এবং ‘intention’ ছিল। “ইউক্রেন বনাম রাশিয়া” মামলাতেই শুধু নয়, একইরকম সিদ্ধান্ত আইসিজে তার ইতিপূর্বের দুটি মামলাতেও গ্রহণ করেছে। মামলা দুটো হোল, “বসনিয়া বনাম সার্বিয়া” (২০০৭) এবং “ক্রোয়েশিয়া বনাম সার্বিয়া” (২০১৫)।
আচ্ছা, মেনে নিলাম, কোন কারণে আইসিজে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হোল যে মিয়ানমারে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের কী লাভ হবে? এটা ঠিক যে, একটি নৈতিক বিজয় হবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে, কিন্তু বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার কি সমাধান হয়ে যাবে আইসিজিতে পাওয়া রায়ের সাথে সাথে? অবশ্যই না। তাহলে এই স্বীকৃতির সার্টিফিকেট নিয়ে আমাদের কি লাভ?
(২) অং সান সু চির বিচার? – আমাদের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই দিবাস্বপ্ন দেখছেন, আইসিজেতে মিয়ানমারের গণহত্যা প্রমাণিত হলে দেশটির নেত্রী অং সান সু চির বিচার হবে। আসলেই কি তাই? আইসিজে কি ক্ষমতা রাখে কোন ব্যক্তির বিচার করবার? আইসিজে আইনে কি আইসিজেকে এই এখতিয়ার দেয়া হয়েছে? আমাদের অতি আবেগ মাঝে মাঝে আমাদের বিভ্রান্ত করে।
আইসিজে যে আইন দিয়ে পরিচালিত হয় তার নাম, Statute of the International Court of Justice, 1945। এই আইনের ৩৬ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে আইসিজের এখতিয়ারের ব্যাপারে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইসিজে যে কোন উদ্ভূত বিরোধ নিরসনে মোট চারটি বিষয়ে এখতিয়ার রাখে-
- ক) কোন আন্তর্জাতিক চুক্তির আইনগত ব্যাখ্যা প্রদান করবার;
- খ) আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে উত্থাপিত কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার;
- গ) আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা লঙ্ঘন প্রমানে সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার; এবং
- ঘ) আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা লঙ্ঘনের প্রমান পাওয়া গেলে ক্ষতিপূরণের প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ধারণ করবার।
তাহলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রমাণিত হলেও, আইসিজেতে অং সান সু চি কেন, অন্য কোন ব্যক্তিরই বিচার হওয়া সম্ভব না। ব্যক্তির বিচার করার কোন এখতিয়ারই নেই আইসিজের। আর তাই আইসিজে তে সু চীকে “এক হাত দেখে নেব” বলে যারা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন, তারা নিরাশ হতে বাধ্য।
(৩) রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবসন? – আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলার মাধ্যমে কি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করাতে পারবে? গাম্বিয়া যে মামলাটি আইসিজেতে করেছে সেখানে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের ব্যাপারটি মোটেও বিচার্য বিষয় নয়। আইসিজে আইনের অনুচ্ছেদ ৪১ অনুযায়ী গাম্বিয়া এই মুহূর্তে শুধু চাইছে যে মিয়ানমারে চলমান গণহত্যা বন্ধের একটি “প্রভিশনাল” বা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের নির্দেশ যেন আইসিজে তার রায়ে দেয়। তার মানে মিয়ানমারে যে গণহত্যা (গাম্বিয়ার পক্ষে আইনগতভাবে প্রমাণসাপেক্ষে) হয়েছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে আইসিজে যেন মিয়ানমারে ভবিষ্যৎ রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের জন্য মিয়ানমারকে প্রয়োজনীয় অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেয়।
ধরে নিলাম, তথ্য-উপাত্ত এবং আইনী বিবেচনায় আইসিজে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হোল যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা হয়েছে, আর তাই মিয়ানমারের উচিৎ অবিলম্বে এরকম রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের চেষ্টা করা। কিন্তু ইতিমধ্যে যেসব শরণার্থীরা মিয়ানমারে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশে বসবাস করছে তাদের কি হবে? আইসিজে কি এমন কোন নির্দেশনা দিবে তার রায়ে? নাকি গাম্বিয়া এমন কোন নির্দেশনা দেবার আবেদন করেছে? উত্তর হচ্ছে, না। তাহলে এই আইসিজে শুনানি থেকে বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবসন ঘটানোর কোন নির্দেশ আসার সম্ভাবনা নেই।
তবে, বাংলাদেশ নিজে আইসিজের পক্ষভূক্ত রাষ্ট্র। আইসিজে আইনের অনুচ্ছেদ ৬২ অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্র চাইলে “গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার” মামলাতে intervene করে বা পক্ষভুক্ত হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের ওপর আইসিজে থেকে “প্রভিশনাল” বা অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা চাইতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ তা না করে, শুধু এক দল পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে আর গাম্বিয়াকে লজিস্টিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েই ক্ষান্ত থাকলো। কেন? লড়াইটা তো আমরা সরাসরিও করতে পারতাম। মাথা যখন আমার, মাথা ব্যাথাটাও আমাকে সারাতে হবে। সময় এখনও চলে যায়নি। আমরা চাইলে এখনও “গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার” মামলাতে intervene করতে বা পক্ষভুক্ত হতে পারি।
(৪) আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি? – আমাদের অনেকের প্রত্যাশা, আইসিজেতে চলমান “গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার” মামলার মাধ্যমে পুরো বিশ্ব মিয়ানমারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। মিয়ানমার একটি গণহত্যাকারী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হলে, বিশ্বের সকল রাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য থাকবে। আসলেই কি তাই? আইসিজে আইনের ৫৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে যে আইসিজের রায় শুধুমাত্র মামলার পক্ষদ্বয়ের ওপর বাধ্যতামুলক। অতএব, আইসিজের রায় শুধুমাত্র গাম্বিয়া এবং মিয়ানমারের ওপর বাধ্যতামূলক, আর কোন রাষ্ট্রের ওপর নয়। এই রায় নিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে কোন বাধ্য বাধকতার মধ্যে ফেলতে পারবে না। বাংলাদেশ পারবে, যদি বাংলাদেশ নিজে এই মামলাতে পক্ষভুক্ত হয়। আর সেই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ এখনও গ্রহণ করেনি।
আরেকটি ব্যাপার, আইসিজের মামলা চলবে বহু বছর। তবে বর্তমানে যে শুনানী চলছে মিয়ানমারের ওপর “প্রভিশনাল” বা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে, তার সিদ্ধান্ত আসলে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে? মেনে নিলাম, গাম্বিয়ার পক্ষে আইসিজে রায় দিল এবং “প্রভিশনাল” বা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমারকে অবিলম্বে তার রাষ্ট্রীয় সীমানায় গণহত্যা বন্ধের নির্দেশনা দিল। মিয়ানমার কি তা মানতে বাধ্য? কাগজে-কলমে তো আইসিজের রায় তার ওপর বাধ্যতামুলক। কিন্তু, যেখানে মিয়ানমার মানতেই বাধ্য না যে কোন রোহিঙ্গা গণহত্যা মিয়ানমারে কখনও সংঘটিত হয়েছে, সেখানে কী গণহত্যা তারা বন্ধ করবে? সুতরাং তারা যদি সেটা না করে, তাহলে কি হতে পারে? আইসিজের রায় কার্যকর কি করে হবে?
আইসিজে আইনের ৪১(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি আইসিজে কোন মামলাতে “প্রভিশনাল” বা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়, তবে তার নোটিশ শুধু মামলা পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র সমুহকেই দেবে না, আইসিজে সেই “প্রভিশনাল” বা অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনার নোটিশ জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল বা নিরাপত্তা পরিষদের কাছেও পাঠাবে। উদ্দেশ্য হোল আইসিজের রায় না মানা দেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে যেন নিরাপত্তা পরিষদ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সরিষার ভূত তো এখানেই বসে আছে। চীন এবং রাশিয়া ক্ষমতা ব্যবহার করে কিছুতেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেবে না। তাহলে দাঁড়ালোটা কী? আমরা যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রইব।
তাহলে এই মুহুর্তে বাংলাদেশের করণীয় কি? প্রথমতঃ বাংলাদেশের উচিৎ আইসিজি আইনের ৬২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার” মামলাতে intervene করে বা পক্ষভুক্ত হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের ওপর আইসিজি আইনের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইসিজে থেকে নির্দেশনা চাওয়া। দ্বিতীয়তঃ শুধু মিয়ানমার নয়, বরং সর্বাত্মক গুরুত্ব দিয়ে চীন এবং রাশিয়ার সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি করা।
লেখক: আইনজীবী ও আইনের অধ্যাপক।