কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছে— কিন্তু অভিযুক্ত আসামিকে এজন্য যেতে হবে না কারাগারের চার দেয়ালের ভেতর, সাজা খাটবেন তিনি নিজের বাড়িতেই। এমন অভিনব এক রায় দিয়েছে পার্বত্য জেলার একটি আদালত।
গত বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) খাগড়াছড়িতে এমন অভিনব রায় দিয়েছেন জেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (প্রথম আদালত) মো. সামিউল আলম।
এতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে পুরো খাগড়াছড়িজুড়েই। সমাজসেবা অধিদফতরের ‘প্রি-সেন্টেন্স’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’-এর আওতায় দণ্ড পাওয়া আসামিকে পাঠানো হয়েছে তার নিজের বাড়িতে।
অভিনব হলেও এমন রায় আইনসম্মত— বলছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এমন রায়ের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কারাগারে গিয়ে অপরাধীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থেকে আদালতের দেওয়া শর্ত মেনে নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারবেন।
খাগড়াছড়ি আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার উদ্দিন মামুন রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বিচারক সামিউল আলম শুধু প্রবেশন সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করেননি, তিনি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে জেলখানার অপরাধীদের সংস্পর্শ থেকে বাঁচিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলার লাম্বাছড়া গ্রামের আবদুর রহমান মিয়াকে মারধর করেছিলেন তার প্রতিবেশী আবদুস সামাদ। এ ঘটনায় সামাদকে আসামি করে ওই বছরের ১ মার্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন আবদুর রহমান। এর প্রায় আট মাস পর ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মামলায় সাক্ষ্য দেন ছয় জন। একবছরেরও বেশি সময় পরে সাক্ষ্য-প্রমাণে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণা করেন খাগড়াছড়ি জেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (প্রথম আদালত) মো. সামিউল আলম। রায়ে বিচারক আসামিকে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন। তবে এই কারাদণ্ডাদেশ ভোগের জন্য আসামি সামাদকে কারাগারে যেতে হচ্ছে না। ছয় মাসের কারাদণ্ড তিনি কাটাবেন নিজের বাড়িতেই। আর এজন্য মানতে হবে ১১টি শর্ত।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. শাহীন হোসেন জানান, আসামিকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিলেও বিচারক তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে কারাদণ্ড স্থগিত রেখে সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তার কাছে ‘প্রি-সেন্টেন্স রিপোর্ট’ তলব করেন। পরে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা কৃতি বিজয় চাকমা ২ জানুয়ারি আসামি মো. আবদুস সামাদের অপরাধ ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’-এর ৪(১) ধারা অনুযায়ী পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় প্রবেশনযোগ্য মতামত দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদন গ্রহণ করে বিচারক কারাদণ্ডের ছয় মাস মেয়াদে আবদুস সামাদকে ১১ শর্ত মেনে বাড়িতেই থাকার নির্দেশনা দেন।
এর আগে গত বছরের ১০ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এক রায়ে ১ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া এক আসামিকে কারাগারের বদলে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকার সাজা দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালে বিভিন্ন মামলায় কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া ১২ আসামিকে কারাগারের বদলে বাড়িতে থেকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেন রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
ব্যতিক্রমী আইনটিতে যা আছে
প্রয়োগের নজির তেমন না থাকলেও প্রবেশন অর্ডিন্যান্স আগে থেকেই আছে। সুপ্রিম কোর্টের জে-০১/২০১৯ নম্বর সার্কুলারে বর্ণিত নির্দেশনা অনুসরণ করেই এই আদেশ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনটি কার্যকর করতে সারাদেশের বিচারকদের নির্দেশনা দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করেন। পরিপত্রে বলা হয়, প্রবেশন মঞ্জুর করার সময় সংশ্লিষ্ট বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেটকে আদালতে প্রবেশন কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে এই আইন অনুযায়ী কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা না হলে আদালত তার যৌক্তিক কারণ লিখিত আকারে রাখবেন।
দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এর ৪ ধারায় বলা আছে, যারা এর আগে কখনো দণ্ড পেয়েছে বলে প্রমাণিত নয় কিংবা দুই বছরের বেশি মেয়াদে কখনো দণ্ড পায়নি, তাদের ক্ষেত্রে প্রবেশন ধারাটি প্রযোজ্য হতে পারে। আসামির বয়স, চরিত্র, পূর্ব ইতিহাস কিংবা শারীরিক অথবা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরণ বা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বিচারক এই ধারা প্রয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সাজার মেয়াদে কারাগারে না থেকে মুক্তভাবেই বিচরণ করতে পারবেন আসামি। তবে এই মেয়াদের মধ্যে তিনি আর কোনো অপরাধ করতে পারবেন না এবং তাকে সদাচরণ করতে হবে। এছাড়াও বিচারক তাকে এই মেয়াদের জন্য বিভিন্ন শর্ত আরোপ করতে পারেন। শর্ত ভঙ্গ করলে তাকে ফের কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে।