মোঃ শওকত হোসাইন:
একজন বিচারক/ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অসংখ্য ধর্ষক এবং ভিকটিমের (ধর্ষিতার) জবানবন্দি গ্রহণ করেছি। পড়াশোনাও করেছি অপরাধতত্ব (Criminology) এবং অপরাধীর মনোবিজ্ঞান (Criminal Psychology) নিয়ে। পেশাগত এবং একাডেমিক অভিজ্ঞতা থেকে ধর্ষণ, ধর্ষক, ধর্ষিতা এবং এই সম্পর্কে গণ-মনস্তত্ব বিষয়ে কিছু লেখা প্রয়োজন মনে করেছি বলেই এই দীর্ঘ লেখা।
কুর্মিটোলা ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত/সম্ভাব্য ধর্ষক ধরা পড়েছে। তার নাম মজনু, সে একজন ভবঘুরে, মাদকাসক্ত, অল্প- বুদ্ধিসম্পন্ন ( low IQ, Idiotic), রেললাইনের পাশের খুপড়িতে থাকা, শীর্নকায় যুবক।
এই আসামী ধরা পড়ার আগে থেকেই বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছিল যে ভিকটিম বলেছিল অপরাধীর বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, অপরাধীর গায়ের রং শ্যামলা, অপরাধীর উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, চুল ছোট করে কাটা, অপরাধীর পরনে ময়লা প্যান্ট এবং পুরনো জ্যাকেট ছিল, ভিকটিম আরো বলেছে অপরাধীর সামনের দুইটা দাঁত নাই। এই সবই ধরা পড়া আসামীর সাথে হুবহু মিলে যায়। ভিকটিম আরো বলেছিলেন যে অপরাধী তার মোবাইল এবং ২০০০ টাকা নিয়ে গেছে। তার পোশাকের বিবরণ এবং মোবাইল ও ২০০০ টাকা নিয়ে যাওয়া ইঙ্গিত করে যে সে ছ্যাচ্ছর স্বভাবের, দরিদ্র এবং ছিনতাইকারীও বটে। সে যেরকম ইম্পালসিভ (impulsive) বা প্রবৃত্তি – তাড়িত এবং যেরকম এলোমেলোভাবে অপরাধপট (Crime scene) রেখে গেছে, এবং যেরকম চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করেছে তাতেও অনুমান করা যায় যে সে অশিক্ষিত, অল্প- বুদ্ধিসম্পন্ন এবং অগোছালো প্রকৃতির কোন অপরাধী হবে। এইসবও ধরা পড়া মজনুর সাথে মিলে যায়। তাছাড়া মজনুর কাছ থেকে ভিকটিমের মোবাইল ও চার্জার ও উদ্ধার করা হয়েছে।
ভিকটিম বলেছিল অপরাধী খুব দাম্ভিক ছিল। দাম্ভিক মানে সে খুব শক্তি/নিয়ন্ত্রণ/কর্তৃত্ব দেখাচ্ছিল। সব ধর্ষকই এইটা করে। বলতে গেলে সব অপরাধীরাই এটা করে, এমনকি একজন ছিঁচকে ছিনতাইকারীও যখন ছিনতাই করে তখন সেও খুব ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব প্রদর্শন করে। নিজেকে ক্ষমতাবান প্রদর্শন করা হচ্ছে অপরাধীর আনন্দের একটা উৎস। ভিকটিম দাবী করেছেন যে অপরাধী তাকে পোশাক পরিবর্তনেও বাধ্য করেছে। এটাও ধর্ষকদের একটা সহজাত আচরণ (signature behaviour)। ধর্ষক এটা করে নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করতে চায়। সে নির্দেশ দিচ্ছে – ভিকটিম তার নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হচ্ছে, এইটা দেখে ধর্ষক রাজোচিত অনুভূতি পেতে চায়। ভিকটিম বলেছিল অপরাধী অনেক শক্তিশালী ছিল, ভিকটিম এরকম বলেছে কারণ অপরাধী শক্তি প্রয়োগ করেছিল। ক্লান্ত, নার্ভাস এবং আক্রান্ত যেকোন ভিকটিমের কাছেই মনে হয় যে আক্রমনকারী ছিল অনেক শক্তিশালী- এটাও স্বাভাবিক। এখানে আরো একটি ব্যাপার স্মরনে রাখতে হবে, তা হল- বেশীরভাগক্ষেত্রেই দেখা যায় আঘাত-পরবর্তী (Post Traumatic) বিচ্ছিন্ন মানসিক অবস্থার কারণে ধর্ষিতা তার সাথে ঠিক কি কি ঘটেছিল তার ধারাবাহিক ও গুছানো বিবরণ দিতে পারেননা। এরূপ ক্ষেত্রে ভিকটিম টুকরো টুকরো দুঃস্বপ্নের মতন ঘটনাটা স্মরণ করতে পারেন, আগের ঘটনা পরে বলে ফেলেন বা পরের ঘটনা আগে বলে ফেলেন, কিছু জিনিস মনে করতে পারেন আবার কিছু সহজ জিনিস মনে করতে পারেন না। এমনো দেখা গেছে যে ঘটনা ঘটার পরপরই ভিকটিম অপরাধীর উচ্চতা কত ছিল বা মাথায় চুল ছিল কিনা তা বলতে পারছেন না তবে অপরাধী কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম ব্যবহার করেছিল বা তার উচ্চারণে কোন বিশেষ এলাকার টান (accent) ছিল কিনা তা বলে ফেলতে পারছেন। আবার এমনো দেখা গেছে যে ঘটনা ঘটার পরপরই ভিকটিম পুলিশের কাছে ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠছেন, বা একেবারেই আবেগহীনভাবে ঘটনার বর্ননা দিচ্ছেন। এইসবই ঘটে আঘাতপরবর্তী শরীরবৃত্তীয় ও আবেগগত কারণে। কয়েকদিন যাওয়ার পরে, ভিকটিম আঘাত সামলে নেওয়ার পরে ধীরে ধীরে গুছানো আকারে তার সব মনে পরতে থাকে। এইজন্য ঘটনা ঘটার পরপরই ভিকটিমের কথাবার্তায় কোন অসংলগ্নটা পাওয়া গেলেও তা স্বাভাবিক মর্মে ধরে নিতে হয়। তবে কুর্মিটোলার ভিকটিম নিজে বেশ দৃঢ় নিশ্চয়তার সাথে অপরাধীকে দেখেই চিনতে পেরেছেন এবং সনাক্ত করেছেন।
তো সবকিছু মিলে যাওয়ার পরেও এবং ভিকটিম নিজে আসামীকে শনাক্ত করার পরেও ফেসবুকবাসী কেনো তার ছবি দেখে এতো অবাক/আশ্চর্য? কেনো এতো অবিশ্বাস? এটাতো কোন রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক অপরাধ নয় যে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ষড়যন্ত্র হবে! তাহলে কেনো এতো অবিশ্বাস? অপরাধীর ছবি প্রকাশ হবার পর থেকেই প্রকাশিত সংবাদের নীচে ফেসবুক গোয়েন্দাদের মন্তব্য পড়ে যা বুঝতে পারলাম তা হল মোটামুটি ২টি কারণে ফেবুবাসী বিশ্বাসই করতে পারছেনা যে এই সেই আসল অপরাধী। কারণ দুইটি হল
১) ধরা পড়া মজনু- ফেসবুকবাসী যেমনটি আশা করেছিলেন সেরকম বলিষ্ঠ, ম্যাসকুলিন, ম্যানলি বা দেখতে দুর্ধর্ষ নয়
২) এরকম একজন শীর্নকায় ব্যক্তি কি করে ভিকটিমকে একা একা ফুটপাথ থেকে টেনে হিঁচড়ে/পাঁজাকোলা করে ঝোপে নিয়ে গেলো এবং ভিকটিম কেনো তাকে বাধা দিতে পারলোনা সেইটাও ফেসবুকবাসীর কাছে বিশ্বাস্যোগ্য ঠেকছেনা।
প্রিয় পাঠক, প্রথমেই বলে রাখি, সিনেমায় যেরকম দেখানো হয় যে নায়িকাকে ধর্ষক আক্রমণ করলে নায়িকা তারস্বরে চিৎকার শুরু করে “বাঁচাও বাঁচাও, ছেড়ে দে শয়তান!” বাস্তবে এমন ঘটেনা। বাস্তবে কাউকে আচমকা আক্রমণ করা হলে আক্রান্ত ব্যক্তি স্থানু বা স্থবির হয়ে যায়, তার স্নায়ুতন্ত্র কাজ করেনা, হাত পা কাঁপতে থাকে, মাথা কাজ করেনা, কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারেনা। ভিকটিম প্রায় ‘বিবশ’/’অবশ’ হয়ে যায়। মেডিক্যাল সায়েন্সের ভাষায় এটাকে বলে Tonic immobility বা Local paralysis। যারা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন তারা হয়তো কেউ কেউ এই অনুভূতির সাথে পরিচিত আছেন। আধুনিক নিউরো সায়েন্টিস্টরা গবেষণা করে দেখেছেন যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিম প্রতিরোধ করাতো দূরের কথা – এমনকি চিৎকারও করতে পারেন না। ধর্ষক যতই কম বুদ্ধিসম্পন্ন লোক হোকনা কেনো, সে তার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ভিকটিমদের এই ‘অবশ’/’বিবশ’ প্রতিক্রিয়া ( Tonic immobility) সম্পর্কে ভালোমতই অবগত ছিল, এইজন্যই সে নির্ধিদ্বায় ফুটপাথে আক্রমণ করেছিল। কুর্মিটোলার ভিকটিমকে অপরাধী পেছন থেকে আক্রমণ করার সাথে সাথেই ভিকটিম অবশ হয়ে যায়, সে সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
এবারে আসি অপরাধী দেখতে এরকম চোরের মতন কেনো বা শৌর্যে বীর্যে বলিয়ান, বলিষ্ঠ ও সেইরকম শক্তপোক্ত ‘আসল পুরুষের’ মত দেখতে নয় বলে যারা সন্দেহ করছেন তাদের ব্যাপারে। ধর্ষকদের নিয়ে এফবিআই (Federal Bureau of Investigation) দীর্ঘদিন গবেষণা করে ধর্ষকদের একটা টাইপোলজি/প্রোফাইলিং ( প্রকারভেধ) করেছে। ধর্ষকদের টেস্টোস্টেরন (testosterone বা male hormone) বেশী বা ধর্ষকরা অতিমাত্রায় সেক্সি এরকম কোন প্রমাঞ পাওয়া যায়নি, বরং উল্টোটাই প্রমাণ পাওয়া গেছে বেশী। বেশীরভাগ ধর্ষকই আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে, অনেকেই ধ্বজভঙ্গ বা ইরেকটাইল ডিসফাংশন (erectile dysfunction) এ ভোগে, বেশীরভাগ ধর্ষকরাই নিজের যৌন জীবন নিয়ে হতাশ। এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত বলা দরকার। ধর্ষক আছে ৪ রকমের। যথা,
১) Sadistic
২) Anger Retaliatory
৩) Power Assertive
৪) Power Reassurance
Sadistic ধর্ষকরা যৌন আনন্দ লাভ করার জন্য ধর্ষণ করেনা। সে ধর্ষণ করে ভিকটিমকে অত্যাচার করার জন্য। সে মূলত ভিকটিমের সাফারিং/যন্ত্রণা/ হিউমিলিয়েশান উপভোগ করে। এই ধরনের ধর্ষকরা অধিকাংশক্ষেত্রেই তাদের ভিকটিমকে ধর্ষণের পরে হত্যা করে ফেলে বা চরম যন্ত্রণা যেমন সিগারেটের ছ্যাকা দেওয়া বা হাত পা, স্তন, যোনিপথ কেটে ফেলা এইসব করে আনন্দ লাভ করে। তবে এরকম Sadistic ধর্ষকের সংখ্যা পৃথিবীর মোট ধর্ষকদের মাত্র ৪ বা ৫ শতাংশ। ভৌতিক অথবা প্রতিশোধমূলক সিনেমায় এই ধরনের ধর্ষকদের বেশী বেশী দেখানো হয় বলে সাধারণভাবে মানুষ মনে করে ধর্ষক মাত্রই স্যাডিস্টিক রেপিস্ট।
দ্বিতীয় টাইপটি হচ্ছে Anger Retaliatory রেপিস্ট। এরাও যৌন আনন্দের আশায় ধর্ষণ করেনা। এই ধরণের ধর্ষকদের বেশীরভাগেরই নিজেদের শৈশবে নির্যাতিত হবার ইতিহাস আছে। এরা বেশীরভাগই ছোটবেলায় মায়ের হাতে বা দাদীর হাতে বা চাচী বা বড় বোনের হাতে প্রচণ্ড মারধরের বা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল (childhood abuse by mother or mother figure women)। সেই থেকে এরা নিজের অবচেতন মনে পৃথিবীর সকল নারীর প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং বিদ্বেষ লালন করে । এদের অনেকেই হয়তো নিজেই জানেনা যে সে নিজের অবচেতনে পৃথিবীর সকল নারীর প্রতি এরকম ঘৃণা/বিদ্বেষ) বহন করে বেড়াচ্ছে। এরা ধর্ষণ করে নিজের এই রাগ/বিদ্বেষ চরিতার্থ করার জন্য। প্রতিশোধ নেয়ার মতন একটা বিকৃত আনন্দ এরা পায় ধর্ষণ করে। এই প্রকারের ধর্ষকরাও তাদের ভিকটিমের সাফারিং/অপমান/যন্ত্রণা উপভোগ করে প্রতিশোধের আনন্দ পায়। এদের সংখ্যাও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।
তৃতীয় প্রকারটি হচ্ছে Power Assertive ধর্ষক। এরা মূলত ধর্ষণ করে নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করার জন্য। নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করার বিকৃততম ও সহজতম উপায় হচ্ছে অন্যকে অপমান করা। এদের কাছে এই ক্ষমতাবান মনে করার অংশ হচ্ছে ধর্ষণ করা (They rape because that’s how they feel that they are powerful, that they can rape or do whatever they want to) এদের চলাফেরায় দেখবেন একটা অতিরিক্ত গা-জোয়ারি ভাব আছে, অতিরিক্ত ব্যাটাগিরি দেখানোর প্রবণতা আছে, নিজেকে মাচো গাই (macho guy) বা তেজস্বী পুরুষ দেখানোর একটা প্রবণতা আছে এদের মধ্যে। প্রায়শই এরা দলবেধে (Gang) চলাফেরা করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এরাও ভিতরে ভিতরে নিরাপত্তাহীন এবং আত্মবিশ্বাসহীন বলেই এরকম অতি ক্ষমতাবান ভাব নেয়ার চেষ্টায় থাকে। এরা বেশীরভাগই ইম্পালসিভ (Impulsive) স্বভাবের (মাথামোটা এবং গোয়ার প্রকৃতির যে কিনা আগুপিছু না ভেবেই কাজ করে ফেলে) এবং নিম্ন (Below Average) বুদ্ধিমত্তার হয়। এই প্রজাতির পুরুষেরা বন্ধুর সাথে করমর্দন (handshake) করার সময়ও প্রয়োজনের চেয়ে জোরে হাতে চাপ দিবে৷ “কিরে দোস্ত কেমন আছিস” – বলে বন্ধুর পিঠে চাপড় দেবার সময়ও এরা অন্যদের চেয়ে জোরে চাপড় দিবে। এরা সাধারণত স্কুলে বা কলেজে বা ভার্সিটিতে বুলি {bully (প্রতিনিয়ত অন্যদের, বিশেষত তারচেয়ে দুর্বলদের পিছনে লেগে থাকা)} টাইপের হয়। অধিকাংশক্ষেত্রেই এরা সিরিয়াল রেপিস্ট বা সিরিয়াল নির্যাতনকারী হয়ে থাকে। কিছুদিন পরপর কোন নারী বা শিশু বা দুর্বল ব্যাক্তিকে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন বা অপমান অপদস্থ না করতে পারলে এদের নিজেকে যথেষ্ট ক্ষমতাবান মনে হয়না, নিজেকে মনে হয় পানসে/ম্যান্দা মারা, মনে হয় কি যেন নাই – সামথিং ইজ মিসিং। এইজন্য এই টাইপের ধর্ষক ধরা পরার আগ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট বিরতিতে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকে। তবে Power Assertive ধর্ষকদের সংখ্যাও ১০ শতাংশের বেশী না।
সবশেষে, বেশীরভাগ – প্রায় ৭৫% ধর্ষকই হচ্ছে Power Reassurance টাইপের। এরা মূলত নিজের ম্যাসকুলিনিটি বা পৌরুষ নিয়ে আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়, মোহনীয় ব্যক্তিত্বের অভাবে বা অন্য যেকোন কারনেই হোক এরা বন্ধুমহলেও তেমন একটা জনপ্রিয় নয়। হয়তো ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময়ও সহপাঠী মেয়েরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। সবমিলিয়ে সে মূলত একজন নিরাপত্তাহীন, পরাজিত এবং আত্মবিশ্বাসহীন ব্যক্তি। তার ধারণা সে নারীদের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক নয়, মেয়েরা কেনো তাকে পছন্দ করেনা এই নিয়ে সে পৃথিবীর সকল নারীর ওপর কিছুটা ক্ষিপ্ত এবং নিজের প্রতি কিছুটা হতাশও বটে, তার সন্দেহ হয় যে “I may not be man enough to conquer women that I deserve”, এই রূঢ় বাস্তবতা সে আবার মেনেও নিতে পারেনা। এই বিপরীতমুখী আবেগের অত্যাচারে সে নিজের সাথেই নিজে দগ্ধ হতে থাকে। মোটাদাগে দুইটা ভ্রান্ত ধারণায় (illusion) সে ভুগতে থাকে। যথা
- আমি আসলে যোগ্য এবং পুরুষালী (manly) তবে মাঝে মাঝে মনে হয় আমি হয়তো যথেষ্ট পুরুষালী বা আকর্ষণীয় নই, তবে – সুযোগ পেলে একদিন দেখিয়ে দিতাম।
- মেয়েরা মুখে যতই না বলুক, একবার মেয়েদেরকে কাবু করতে পারলে নারীরা আসলে ধর্ষণ উপভোগই করবে (ইভটিজিং করলে মনে মনে মেয়েরা খুশী হয় এরকম একটা বাংলা ফেসবুক পেইজে প্রায় ২ লক্ষ লাইক/ফলোয়ার ছিল- পেইজটা এখন আর নাই)।
যাইহোক, নিজের পৌরুষ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে সে কোন নারী’কে ধর্ষণ করে নিজের পৌরুষ জাহির করতে চায়, নিজেকে সুপার ডুপার, ম্যাসকুলিন এবং তেজস্বী হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। কার কাছে সে এই পৌরুষ জাহির করে? নিজের কাছেই। সে আশ্বস্ত (reassure) হতে চায় নিজের কাছে। এইজন্য এই ধরণের ধর্ষকদের নাম power reassurance। প্রায় ব্যাতিক্রমহীনভাবেই এই ধরনের রেপিস্টরা আক্রমণ করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভিকটিম যথা বাসার কাজের মেয়ে, গার্মেন্টস কর্মী, দুর্বল পথচারী, প্রতিবন্ধী নারী, নিজের বাসার ভাড়াটিয়া, অফিসের অধস্তন, প্রবাসীর স্ত্রী, নিজের ছাত্রী, ভিখিরি বা ভাসমান নারী এবং কমবয়েশী শিশু বা ভালনারেবল ভিকটিমদের। এই প্রজাতির রেপিস্টদের সংখ্যা মোট রেপিস্টদের প্রায় ৭৫%।( এই ধরনের রেপিস্টরা যে সবসময়ই অশিক্ষিত বা দরিদ্র শ্রেনীরই হবেন তা নয়- একজন শিক্ষিত, সচ্ছল, কর্মজীবনে সফল, গায়ে গতরে শক্তিশালী, অফিসের বস ব্যক্তিও নিজের পৌরুষ নিয়ে আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতে পারেন)। এই ধরনের রেপিস্টদেরও সিরিয়াল রেপিস্ট হবার প্রবণতা আছে। কারণ যেই ভ্রান্ত ধারণা (illusion) থেকে সে ধর্ষণ করতে গিয়েছিল, বাস্তব অভিজ্ঞতা তার চেয়ে সম্পূর্ণই ভিন্নরকম হয়। সে প্রত্যাশা করেছিল ভিকটিম হয়তো ব্যাপারটি উপভোগই করবে এবং সে যে আসলেই একজন যথেষ্ট ম্যানলি এবং ‘ আসল পুরুষ’ তা প্রমাণ হবে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো ভিকটিম তাকে ঘৃণা করছে, বাধা দিচ্ছে বা মুষড়ে পরেছে। এরূপ ক্ষেত্রে Power Reassurance রেপিস্ট ধরে নেয় যে সে হয়তো ভুল ভিকটিম চুজ করেছে, এই ভিকটিমের নিশ্চয়ই নিজেরই কোন সমস্যা আছে, নাহলে এমনতো হবার কথা ছিলনা! নেক্সট টাইম নিশ্চয়ই সে যেরকম ভাবে সেরকমই ঘটবে।
কুর্মিটোলা রেইপ কেসের আলোচ্য অপরাধীটি হচ্ছে এই প্রজাতির (Power Reassurance) রেপিস্ট (তার মধ্যে anger retaliation এর কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে)।
নিজের পৌরুষ সম্পর্কে অনিশ্চিত, ইনসিকিউরড এবং আত্মবিশ্বাসহীন রেপিস্টদের সংখ্যা যদিও মোট রেপিস্টদের ৭৫% তবুও কোন এক অজানা কারণে আমাদের দেশের অনেকের ধারণা রেপিস্ট মানেই বাহুবলি টাইপের দুর্ধর্ষ, বলশালী- সেইরকম ম্যাসকুলিন কোন পুরুষ। কি অদ্ভুত বৈপরিত্য!
এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে রেপিস্ট কেন ভাবা শুরু করলো যে কাউকে রেইপ করতে পারলে নিজেকে ‘আসল পুরুষ’/ real man বা ক্ষমতাবান পুরুষ হিসেবে জাহির করা যাবে?( আমি এমন ঘটনার উদাহরণও জানি যেখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে মারধর করে মারধরের ছবি/ভিডিও তার বন্ধুদের দেখিয়ে খুব পুরুষালি ভাব নিচ্ছিল যে “দ্যাখ আমার স্ত্রী’ কে আমি কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখি, বা কন্ট্রোলে রাখি – Look, who is the real boss”!) কেনইবা রেপিস্টরা তাদের ম্যাসকুলিনিটি আশ্বস্ত (reassure) করার জন্য রেইপ করা আবশ্যক মর্মে ভেবে নিলো? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে কুর্মিটোলা ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের নীচে বঙ্গীয় ফেসবুকবাসীর মন্তব্য পড়লে। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে মন্তব্য দেখলাম যারা কমেন্টে তাদের বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছেন ধরা পরা মজনুর ছবি দেখে। এই কমেন্টকারীদের মাথার ভিতর রেপিস্ট এর ছবি আঁকা আছে বলশালী, বলিষ্ঠ, তেজী, সেইরকম ম্যাসকুলিন কোন পুরুষ হিসেবে। এই কমেন্টকারীরা বেশীরভাগই ধর্ষণকে বীরোচিত কাজ হিসেবেই কল্পনা করে নিয়েছেন। সন্দেহভাজন মজনুকে যথেষ্ট পরিমানে বীরপুরুষ মনে হচ্ছেনা অথচ মজনু কেমন করে ধর্ষণের মতন এমন বীরোচিত একটি কাজ করে ফেললেন এই হিসেব তারা মিলাতে পারছেন না। মজনুকে নিয়ে খুব বেশী দুশ্চিন্তার কারণ নেই কেননা সে ইতিমধ্যেই ধরা পরেছে, তবে সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষ যে ধর্ষণকে বীরোচিত কাজ হিসেবে ধরে নিচ্ছে এটা খুবই চিন্তার বিষয়। Power Reassurance রেপিস্টরা সমাজের এই বিদ্যমান ম্যাসকুলিন ম্যান, বা রিয়েল ম্যান বা বীরপুরুষের আইডিয়া থেকেই রেইপ করে নীজের বীরত্ব জাহির করতে অনুপ্রাণিত হন। Power Reassurance রেপিস্ট নিজেকে (নিজের কাছেই) বীর হিসেবে প্রমাণ করার জন্য রেইপ করেন। এই যে, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী ফেসবুক ইউজারের চিন্তাভাবনা Power Reassurance রেপিস্ট এর চিন্তাধারার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে- এটা যে কতবড় দুঃসংবাদ তা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি? কারণ ফেসবুকবাসীরাতো আদতে দেশবাসীই, নাকি?
প্রিয় পাঠক, ধরা পড়া মজনু যে আসলেই অপরাধী তা ভিকটিম নিজেই নিশ্চিত করেছেন। (তবুও তর্কের/আইনের খাতিরে আমরা তাকে এখন আসামী বলবো, রেপিস্ট বলছিনা) বেশীরভাগ (অন্তত power reassurance টাইপের ৭৫ ভাগ) রেপিস্টরাই এরকম দুর্বল চরিত্রের, আত্মবিশ্বাসহীন লুজার এবং লো আইকিউ সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবুও শুধুমাত্র মজনুকে দেখেই যারা হতাশ হয়েছেন এবং যারা ধরেই নিয়েছেন যে রেপিস্ট মানেই বলিষ্ঠ, ম্যাসকুলিন, এবং সেইরকম ব্যাপার-স্যাপার তারা ভুল করছেন, আপনাদের এই ভাবনাই প্রকারান্তরে power reassurance রেপিস্টদেরকে ধর্ষণ বা নারীর ওপর চড়াও হয়ে নিজের ম্যাসকুলিনিটি নিশ্চিত (reassure) করে নিতে প্রেরণা যোগায়। এই সমাজের লক্ষ লক্ষ মানুষেরা যদি এরকমই ভাবতে থাকেন, তাহলে কাচুমাচু হয়ে থাকা সম্ভাব্য power reassurance রেপিস্টরা যেই মেসেজটি পাবে তা হচ্ছে – নিজেকে ম্যাসকুলিন এবং তেজস্বী / রিয়েল ম্যান হিসেবে প্রমাণ করার জন্য বলবান পুরুষ হওয়া বা নারীর প্রতি বলপ্রয়োগ করা বা রেইপ করা আইডিয়া হিসেবে মন্দ নয়।
সংযুক্তি-১: সরকারী প্রতিষ্ঠানসসমূহের কাজের সচ্ছতার অভাবে বা দীর্ঘ বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারনে হতাশা থেকে যারা সন্দেহ পোষণ করেছেন তাদের জন্য সমবেদনা, একটা উত্তেজনাকর গল্পের সাদামাটা সমাপ্তি দেখে যারা হতাশ হয়েছেন তাদের জন্য থাকলো করুনা। এই লেখার বিষয়বস্তু হচ্ছে অভিযুক্ত মজনু শীর্নকায় বলে সে রেইপিস্ট হতে পারেনা এই পুর্বানুমানকে খন্ডন করা, ভিকটিম কেনো অভিযুক্ত মজনুকে পাল্টা আঘাত করতে পারলোনা তার ব্যখ্যা দেওয়া, এবং বলিষ্ঠ ও ম্যাসকুলিন হবার সাথে ধর্ষক হবার যে কোন সম্পর্ক নেই তা দেখানো এবং নিজেকে ম্যাসকুলিন/ম্যানলি বা ‘আসল পুরুষ’ হিসেবে জাহির করার জন্য কেউ কেউ যে ধর্ষক হয়ে উঠতে পারেন সেই মনস্তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা।
সংযুক্তি-২: যথেষ্ট সহ্য ও ধৈর্য নিয়ে লেখাটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখক: যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, চরফ্যাশন, ভোলা।