শহিদুল সজীব:
ক্রসফায়ার, এনকাউন্টারকিংবা বন্দুকযুদ্ধ যে নামেই ডাকিনা কেন এগুলো এতোদিন একটা মোড়কে লাজ-লজ্জার ভিতরে ছিলো। আসামীকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়ার পর ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়বে, পুলিশও পালটা গুলি ছুড়বে। এরপর ঘটনাস্থলে আসামীর গুলিবিদ্ধ লাশ আর কিছু দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাবে। এমন প্রেসব্রিফিং এর সত্যতা নিয়ে জনমনে যে ভাবনাই থাকুক না কেন তাদের ব্রিফিং তারা করতো, বিশ্বাযোগ্য হোক বা না হোক। র্যাব-পুলিশ বিজিবির এমন প্রেসব্রিফিং দেয়ার কারণ হচ্ছে, এমন হত্যা স্বাভাবিকভাবে আইনসিদ্ধ না। তাই কিছু একটা ব্যাখ্যা দেয়া সাধারণ ভদ্রতা আর কথিত স্বাধীন বিচার বিভাগের নিকট ছোটখাটো জবাবদিহিতার অংশ ছিলো। এখন থেকে সে বালাইও থাকলো না। খোদ আইনপ্রণেতারাই মহান সংসদে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তকে গুলি করে মারার পরামর্শ দিলেন! মাদকের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে বন্দুকযুদ্ধ চালানো হয়েছে ঠিক সেভাবে ধর্ষণের আসামীদের বন্দুকযুদ্ধে নেয়ার আহবান জানানো হয়েছে। আহবান বললে কম হবে, জোর দাবি তোলা হয়েছে। মাননীয় সাংসদগণ স্পষ্টকরে দিয়েছেন দেশের বিচারব্যবস্থার উপর তাদের নিজেদেরই আস্থা নেই। একজন সংসদ সদস্য বলেন, “আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে স্পষ্ট বলতে চাই, ধর্ষণ করা হলো, আসামি ধরা পড়েছে। নির্যাতিতা বলছেন যে সেই আসামি। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে নিয়ে গুলি করে মারুক। মানুষ দেখুক তার লাশ পড়ে আছে।”
কি সুন্দর পথ দেখিয়ে দিলেন! জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলতে বলছেন! কি করে নিশ্চিত হচ্ছেন যে অভিযোগকারী মিথ্যে বলবেনা? ব্যক্তিগত আক্রোশে কোন নিরপরাধীকে যে অভিযোগকারী সনাক্ত করে ‘ফাঁসিয়ে দিবেনা’এর নিশ্চয়তা আপনি কিভাবে দিবেন? অভিযুক্ত ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আইনপ্রণেতাগণের ক্রসফায়ারেরএমন দাবি বিচার বিভাগকেই ধর্ষণ করার শামিল!
পরিস্থিতি কতটা নিয়ন্ত্রণহীন হলে একটা দেশের আইনপ্রণেতাগণ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আসামীদের গুলি করে মারার পরামর্শ দেয়? আমজনতা নিরুপায় আত্মসমর্পণমূলক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়! এমনকি এ সংক্রান্ত আইন পাসের দাবিও করা হচ্ছে! এ কেমন ভয়ংকর সময় যাচ্ছে বাংলাদেশের?
কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে তার পক্ষে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে, এটা সাধারণজ্ঞানে সবাই একবাক্যে সমর্থন করবে। অভিযোগকারী তার অভিযোগ প্রমাণ করবে আর অভিযুক্ত সেটা মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে আসামী শাস্তি পাবে। এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠার সাথে সাথে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের তোয়াক্কা না করে শাস্তি দিয়ে দেয়া দুনিয়ার কোন সভ্য মানুষ সমর্থন করবে না। আইন এই কমনসেন্সের বাইরের কিছুনা। আইনও তাই বলে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে একটু চোখ বুলানো দরকার। শুধু ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের দিকে একটু লক্ষ্য করুন। সেখানে বলা আছে, “ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী হইবেন।” আপনি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলে রাষ্ট্র আপনাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে বাধ্য। যতবড় জঘন্য অপরাধেই আপনি অভিযুক্ত হোন না কেন যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী প্রমাণ করে শাস্তি দিতে হবে। কোন অনুমানের উপর ভর করে হুট করে কাউকে শাস্তি দেয়া ন্যাচারাল জাস্টিসের পরিপন্থী। এমনটা করার কোন অধিকার রাষ্ট্রের নেই। থাকতে পারেনা।
দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকান্ড “জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাযজ্ঞ।” এরচেয়ে শোকাবহ ঘটনা বাঙালির জীবনে নেই। সেই নারকীয় হত্যাকান্ডের আসামীদের বিচারও দেশের প্রচলিত আইন মেনে করা হয়েছে৷চূড়ান্ত পর্যায়ের দেশদ্রোহী এসব আসামীদের পক্ষে কোন বিজ্ঞ আইনজীবী মামলা পরিচালনা না করায় রাষ্ট্র আসামীদের পক্ষে লড়ার জন্য “স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ার” নিয়োগ দিয়েছেন। যথাযথভাবে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে শুরু করে সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে দেয়া হয়েছে। এরপর বিজ্ঞ আদালত সাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন। দেশের এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের বিচারে যদি প্রচলিত আইন-আদালতের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায় তবে এখন এমন কি হলো যে খোদ সাংসদরাই আইন ভাঙার নির্লজ্জ ডাক দিচ্ছেন! বিচার বিভাগের উপর এই আস্থাহীনতার দায় কি তারা এড়াতে পারেন? কেন আজ বিচার বিভাগকে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে হচ্ছে?
দেশের অধিকাংশ মানুষ আজ ক্রসফায়ারকে সমর্থন দিচ্ছে। এ লজ্জা কার? কেন মানুষ এমন নিরুপায় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? একযুগ হলো নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কাগজে কলমে আলাদা হয়েছে। আসলেই কি স্বাধীন হয়েছে? দিনের পর দিন নির্বাহী বিভাগকে অসাংবিধানিকভাবে বিচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবছর ডিসি সম্মেলনে নানান বিচারিক আবদারের ফর্দ ঝোলানো হচ্ছে। ধুঁকেধুঁকে বিচারবিভাগ যতটুকু এগুচ্ছে তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে। সাড়ে ৩৪ লক্ষ মামলার পাহাড়ে হাজার দেড়েক বিচারক দিন-রাত কসরত করে যাচ্ছেন। বিচারক সংকট নিয়ে বছরের পর বছর খবর প্রকাশ হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। বিচার বিভাগের এমন দৈন্যদশার জন্য কে দায়ী? সরকার কি তার দায় এড়াতে পারে?
শত বছরের পুরনো আইন পরিবর্তন পরিমার্জনে আইনপ্রণেতাগণ কি ভূমিকা রেখেছেন যে বিচার বিভাগের উপর প্রত্যাশার পারদ এতো উঁচুতে নিয়ে গেছেন? বিচার বিভাগের তো প্রচলিত আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সাংসদ তথা আইনপ্রণেতাগণ কেন এখনো প্রচলিত আইনের ব্যাপক সংস্কার করতে পারেননি? নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে আজ মহান সংসদে ক্রসফায়ারকে বৈধতা দিতে চাচ্ছেন, বাহ! সম্ভবত আমাদের জাতীয় সংসদ পৃথিবীর একমাত্র সংসদ যেখানে আইনপ্রণেতাগণ নিজেরাই আইন ভাঙার আহবান করলেন! বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের আমন্ত্রণ প্রত্যক্ষ করলো।
ক্রসফায়ার দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অপরাধ দমন সম্ভব হলে কিছুদিন আগে হারকিউলিকস খ্যাত অজ্ঞাত লোকের ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞেই অপরাধ থেমে যেতো। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামক বন্ধুক যুদ্ধের পরে দেশে মাদকের ছড়াছড়ি থাকতো না। বিশ্বাস করুন, সমস্যা আরো গভীরে। দয়াকরে সমস্যার মূলে মনোযোগ দিন। মানুষ কেন হিংস্র হয়ে উঠছে? কেন দিনদিন অপরাধ বেড়ে চলেছে সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যবস্থা করুন। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করুন। আক্রমণাত্মক হয়ে সাময়িক স্বস্তি ফিরলেও ফিরতে পারে, তবে সেটা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান না। এর অপব্যবহার না হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়ার মত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আমাদের নেই। একজন নিরপরাধীকেও যদি রাষ্ট্রের অবিচারের শিকার হয়ে বিনাবিচারে মরতে হয়, তাহলে শত ন্যায়বিচারের গল্প মূহুর্তে বিলীন হয়ে যায়। আমরা কি সভ্যতার পেছনের দিকে যাবো?
লেখক: আইনজীবী, শরীয়তপুর জজ কোর্ট। Email: mdshahidulislam0038@gmail.com