দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সংগঠন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২০-২১ সালের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন। দু’দিনব্যাপী এ নির্বাচনে ১১ ও ১২ মার্চ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। এর মধ্যে দুপুর ১টা থেকে দুইটা পর্যন্ত থাকবে বিরতি। নির্বাচনকে ঘিরে গেল মাসখানিক আদালত প্রাঙ্গণ ছিল সরগরম। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং সাধারণ আইনজীবীদের সাথে আলোচনা থেকে উঠে আসা নানান বক্তব্য, বিশ্লেষণ নিয়ে আজ লিখেছেন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচি।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনীত সাদা প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী সিনিয়র আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন, যিনি বর্তমান কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি গতবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে আইনজীবীদের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশ্য সে বিষয়টি তিনি মনেও রেখেছেন, তাঁর পারপরমেন্সে সেটি প্রমাণিত। বিগত এক বছর দায়িত্বের প্রতি তিনি খুব যত্নবান ছিলেন। আইনজীবী এবং বারের উন্নয়নে দৌড়ঝাঁপ কম করেন নি বলে মনে করেন সাধারণ আইনজীবীরা। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি বারের উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা অনুদান আনতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর নেতৃত্বে। বই হচ্ছে আইনজীবীদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কিছুদিন আগে বারের লাইব্রেরীর উন্নয়নে আইনমন্ত্রীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার অনুদান গ্রহণ করে আইনজীবীদের কাছ থেকে প্রশংসিত হয়েছে। আইনজীবীদের বসার সংকট তীব্র। বারের নেতাদের প্রতি সাধারণ আইনজীবীদের প্রধানতম দাবী থাকে তাঁর একটি বসার জায়গার ব্যবস্থা যেন করে দেয়া হয়। গেল মাসের শেষ দিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের আসন সংকট সমাধানের জন্য ‘মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি’র নামে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন সভাপতির নেতৃত্বে বারের নেতৃবৃন্দ। সাধারণ আইনজীবীরা এমন নেতাকেই চান যিনি তাদের কথা ভাবেন। সবমিলে এবারও সভাপতি হিসেবে শক্ত অবস্থায় আছেন বর্তমান সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন।
তবে গতবারের মতো ভোটের ব্যবধান এতো থাকবে না, সেটা কমে আসবে বলে ধারণা করছেন অনেকে। কারণ অপর প্রার্থী যিনি আছেন বিএনপিপন্থী নীল প্যানেলের সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন; তিনি মিষ্টভাষী, বিনয়ী হিসেবে সাধারণ মানুষের মন জয় করা মানুষ। তাছাড়া জাতীয় নেতা হিসেবে সারা দেশেই তাঁর পরিচিতি রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ভোট সারাদেশ ব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই ভোটাররাও সারাদেশ থেকে ছুটে আসে ভোট দেয়ার জন্য। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে প্যানেলের বাহিরেও এলাকা প্রীতি খুব কাজ করে। অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। এই অঞ্চলের প্রচুর ভোটার আছে। এই আঞ্চলিকতাকে অনেকে ভোট ব্যাংক হিসেবে দেখছেন।
এবার এই নির্বাচনে সবার দৃষ্টি একদিকেই; সম্পাদক কে হচ্ছেন। কারণ বিএনপিপন্থী নীল প্যানেল থেকে টানা ৭ বার যিনি সম্পাদক পদে নির্বাচিত ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দল এবার মনোনয়ন দেননি। ব্যাপারটি এমন নয় যে, তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে কিংবা গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। দল হয়তো ভেবেছে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসার দরকার আছে। তাছাড়া আরও যারা রাজনীতি করেন তাদেরও আশা-আকাংখার মুল্য দিতে হয় দলকে। সম্পাদক পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বারবার পরাজয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এবার তাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী দলীয়দের সাথে নিয়ে মরিয়া হয়ে মাঠে ছিলেন।
এবার সম্পাদক পদে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনীত সাদা প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অ্যাডভোকেট শাহ্ মঞ্জুরুল হক। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের অর্থাৎ বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল থেকে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সম্পাদক পদের দুইজনেই নতুন মুখ। তবে আইনজীবীদের কাছে দুইজনেই খুব পরিচিতি ও জনপ্রিয়। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ভোটের লড়াইতেও তারা থাকবেন সমানে সমান।
অ্যাডভোকেট শাহ্ মঞ্জুরুল হক বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। শুনা যায়, শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তাঁর অনেক শিক্ষার্থী এখন আইন পেশায় রয়েছে। যারা তাঁর প্রতি আজও ভক্তি-শ্রদ্ধা, ভালবাসা দেখান। ভোটের মাঠে বিষয়টি প্রভাব প্লাস পয়েন্ট নিঃসন্দেহে। এছাড়া কোন দিন কোন পদে না থেকেও তিনি সবসময়য় আইনজীবীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন। বলা যায়, ভোটারদের কাছে এটা নিরব বার্তা, দায়িত্ব ছাড়া যিনি আইনজীবীদের পাশে থাকেন, দায়িত্ব পেলে নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ ভালবাসা দিয়ে থাকবে। কিছুদিন আগে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম, সে সাক্ষাৎকারটি ইতোমধ্যে প্রকাশও হয়েছে- এক প্রশ্নের কথোপকথন তুলে ধরছি এখানে, ‘ল’ইয়ার্স ক্লাব: কথিত আছে আপনি উদারহস্তের মানুষ, সমিতি কিংবা আইনজীবীদের কল্যাণে আপনার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পর্কে কিছু বলুন’ ‘শাহ্ মঞ্জুরুল হক: ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করার পর তা ফলাও করে প্রচারের পক্ষপাতী আমি না। ধর্মেও বলা আছে কাউকে কিছু দিলে উল্লেখ করো না। এজন্য সেসব বিষয়ে আমি প্রচারবিমুখ তবু আপনার প্রশ্নের খাতিরে উত্তরটা দিচ্ছি, নিজস্ব অর্থায়নে আমি সুপ্রিম কোর্ট বারের ব্যাডমিন্টন ক্লাব করে দিয়েছি, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের বসার জন্য হল রুমগুলোর আধুনিকায়নে আর্থিক অনুদান দিয়েছি, সপ্তম ল’ইয়ার্স ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডকাপে বাংলাদেশ দলের স্পন্সরশীপ করেছি। মসজিদে দু’বার এসি দিয়েছি, নারী হলরুমে এসিসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় সরবরাহ করেছি। এছাড়া ক্যান্সার, লিভার, কিডনি রোগে আক্রান্ত আইনজীবীদের চিকিৎসার্থে সহায়তার হাত বাড়িয়েছি। আর একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমি নাম, যশ, খ্যাতি কিংবা কোন পদ-পদবীর জন্য এসব কাজ করিনি। সম্পাদক নির্বাচিত না হলেও আমার এসকল কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে।’
এবার আসি অপর প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রসঙ্গে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে পড়াশুনা করেছেন। পরবর্তীতে লন্ডন থেকে বার-এট-ল করেন। ঢাবি’র আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পরিবারটি বিশাল। কোর্ট এবং কোর্টের বাহিরে উভয় জায়গায় ভাল অবস্থায় আছেন তারা। এই সাবেক শিক্ষার্থীদের ইউনিটিও বেশ মজবুত। দলের উর্ধে গিয়েও এই ইউনিটিগুলো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। সে হিসেবে বিষয়টি ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের জন্য প্লাস পয়েন্ট। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে ব্যারিস্টার কমিউনিটি। এই এ্যাসোসিয়েশনও নিজেদের বলয় ঠিক রাখার স্বার্থে কমিউনিটির মানুষদের পক্ষে দাঁড়ান দল মতের উর্ধে। সেদিক থেকেও পিছিয়ে আছেন আরেক প্রার্থী। এছাড়াও ব্যারিস্টার কাজল তরুন আইনজীবীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। কারণ তরুন আইনজীবীদের মামলায় তিনি সিনিয়র ব্রিফিং করেন। কথিত আছে তিনি এই ব্রিফিং এর জন্য কখনো কোন টাকা দাবী করেন না, যে যার ইচ্ছেমত যাই দেন তিনি তাই নিয়ে নেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি এই চর্চা করছেন, সে হিসেবে তাঁর বিশাল একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তাঁর এক জুনিয়র, নাম- ফারিয়া ফেরদৌস, এক ফেইসবুক স্ট্যাটাস লিখেছেন এভাবে, ‘২০০৯ সালে আমি ইন্টিমিশন জমা দেই রুহুল কুদ্দুস কাজল স্যারের আন্ডারে, সেই ২০০৯ সাল থেকে স্যারের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছি ২০১৭ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ সময় কাজ করার সুবাদে দেখেছি স্যার অনেক মামলায় সিনিয়র ব্রিফিং করেন, আমরা চেম্বারের জুনিয়ররা বিরক্ত হতাম যে স্যার আপনি অন্যদের এতো মামলা করেন যে আমাদের চেম্বার ক্ষতিগ্রস্থ হয়, স্যার বলতেন “কিছু বোঝ মিয়াঁ, সারাদিন একটা ছেলে এই একটা মামলার আশায় বসে আছে, মামলাটা করলে কিছু ফিস পাবে, আমি মামলাটা করলে সে যদি একটু রিলিফ পায়, সমস্যা কি!” আমি এতো দীর্ঘ বছরে দেখেছি স্যার কোনদিন কোন আইনজীবীকে বলেননি যে এতো টাকা না দিলে আমি মামলায় যাবো না, কোনদিন গুনে দেখেননি যে কত টাকা কে দিলো, আর কি মামলায় দিলো, কে কোন দল করলো বা সে ব্যাক্তিগত ভাবে আমাকে পছনদ করে কিনা; কোর্ট রুমে কোন আইনজীবী মামলাটা করতে পারছেন না, স্যারকে দেখেছি নিজে পারমিশন নিয়ে সেই আইনজীবীকে মামলা করতে ইনস্ট্যান্ট সাহায্য করেছেন!’
সবমিলে বুঝা যাচ্ছে, দলীয় প্যানেল ছাড়াও সভাপতি সম্পাদক পদে যোগ্যতা, জনপ্রিয়তায় কেউ কারও চেয়ে কম নয়; নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকছে শতভাগ।