দেশের প্রত্যেকটি কারাগারে নতুন বন্দিদের ১৪ দিনের জন্য পৃথক ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে। প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণে রাখার পর কারও মধ্যে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে তা পরীক্ষা করার জন্য জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া কারা ফটক দিয়ে প্রবেশের পর বন্দিদের হাত ধোয়া ও পরিষ্কারের জন্য পানি ও সাবানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইসঙ্গে কারাগারের অভ্যন্তরে প্রতিটি ওয়ার্ডে সাবান, হ্যান্ডওয়াশ ও স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া বন্দিদের মধ্যে যাতে আতঙ্ক না ছড়ায়, সেজন্য চিকিৎসক ও কারা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মোটিভেশন দেওয়া হচ্ছে।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ৪৮টি কারাগারে প্রায় ৯০ হাজার কারাবন্দি রয়েছে। করোনা ভাইরাস থেকে কারাবন্দিদের সুরক্ষার জন্য গত ১০ মার্চ কারা অধিদফতর থেকে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। কারাগারগুলো নির্দেশনা মানছে কিনা তা তদারকি করার জন্য বিভাগীয় ডিআইজিদের সপ্তাহে অন্তত দুটি কারাগার পরিদর্শন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত ১০ মার্চ থেকে কারাগারগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে বন্দিদের রাখার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সাধারণ বন্দিদের থেকে পৃথক ভবনে এই ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত আইজিপি কর্নেল আবরার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি ভালো। প্রথম করোনা নিয়ে কথা শুরুর পরই আমরা নির্দেশনা তৈরি করেছি। তখন কেউ কোনও ইনস্ট্রাকশন দেয়নি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর বিস্তারিত করণীয় সম্পর্কে অবহিত করে নতুন নির্দেশনা দিয়েছি। সব কারাগারে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় তিনি বলেন, কারাগারের ভেতরে প্রতিটি ওয়ার্ডে হ্যান্ডওয়াশ ও সাবান ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের কারারক্ষী যারা আছেন, তাদের হ্যান্ডওয়াশ ও স্যানিটাইজার ব্যবহার শুরু করেছি।
নতুন বন্দিদের কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা সম্পর্কে কর্নেল আবরার হোসেন বলেন, নতুন যেসব বন্দি ভেতরে প্রবেশ করছে, তাদের কমপক্ষে ১৪ দিন ইনকিউবেশন পিরিয়ডে রাখা হচ্ছে। জীবাণু প্রবেশের পর থেকে লক্ষণ প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় ইনকিউবিশন পিরিয়ড। কোনও বন্দি যদি বাইরে থেকে জীবাণু নিয়ে আসে, তাহলে ওই জীবাণু থেকে রোগ ছড়ানোর সর্বোচ্চ সময়সীমা পর্যন্ত তাকে আমরা আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইনে রাখি।
উদাহরণ দিয়ে কারা অধিদফতরের এই কর্মকর্তা বলেন, ধরুন আজকে ২০ জন বন্দি এলো, তাদের পৃথক একটা রুমে আমরা ১৪ দিন রেখে দেবো। আগামীকাল আরও ১০ জন এলে তাদের আবার পৃথক আরেকটি রুমে রাখব। আমাদের হিসাব ১৪ দিনের। তারপর অন্য বন্দিদের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে।
কোয়ারেন্টিনে রাখার আগে নতুন বন্দিদের ইনফারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে জানান কর্নেল আবরার হোসেন। তিনি বলেন, বন্দি যারা প্রবেশ করছে তাদের প্রত্যেকের তাপমাত্রা মাপার চেষ্টা করছি।এখন আমরা ইনফারেড থার্মোমিটারের অর্ডার দিয়েছি। সব কারাগারে আমরা পাইনি। আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে দেশের সব কারাগারে সরবরাহ করতে পারব।
সব কারাগারে ইনফারেড থার্মোমিটার না থাকায় এখন চিকিৎসকদের মাধ্যমে জ্বর সর্দি নিয়ে আসা বন্দিদের চেকব্যাক করা হচ্ছে বলে জানান আবরার হোসেন। বন্দিদের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, নতুন সবাইকে ১৪ দিন থাকতে হবে।এরমধ্যে সর্দি কাশি নিয়ে যারা আসছে তাদের চিকিৎসা তাৎক্ষণিক করা হচ্ছে। যারা কারাগারের ভেতরে সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের আলাদা করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা হিসেবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।সন্দেহজনক কাউকে পাওয়া গেলে পরীক্ষার জন্য আমরা পাঠাচ্ছি।
কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পাওয়ার পর কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর হাসপাতালের চতুর্থ তলায় একটি ফ্লোর আলাদা করা হয়েছে। সেখানে সর্দি হাঁচি কাশি নিয়ে যারা আসছে, তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সহকারী সার্জন ডা. খুরশিদ আলম। তিনি বলেন, কারা অধিদফতর থেকে নির্দেশনা দেওয়ার পর গত সপ্তাহে সিনিয়র জেল সুপার, জেলার, ডেপুটি জেলার, চিকিৎসক, মেডিক্যাল স্টাফদের একটা বৈঠক হয়েছে। প্রত্যেককে করোনা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ডা. খুরশিদ আলম বলেন, প্রতিদিন আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ আসামি বাইরে থেকে আসে। এদের ১৪ দিন আলাদা করে রাখা হচ্ছে। দুটি বিল্ডিংয়ে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কারা হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রত্যেক আসামি আসার সঙ্গে সঙ্গে ইনফারেড থার্মোমিটার দিয়ে চেক করা হচ্ছে। যাদের তাপমাত্রা বেশি, তাদের কারা হাসপাতালে চারতলায় একটা ফ্লোরে আলাদা করে রেখেছি। ওটা আইসোলেশন ইউনিট। যেসব রোগী জ্বর হাঁচি কাশি নিয়ে আসছে, তাদের আলাদাভাবে ১৪ দিন সেখানে রাখছি। এখন পর্যন্ত ৬০০ জন আছে। তবে কারও মধ্যে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি।
কারাবন্দিদের করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে স্বজনদের সাক্ষাৎ সীমিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদফতরের এআইবি (এডমিন) মো. মঞ্জুর হোসেন। তিনি বলেন, বন্দিদের সঙ্গে সর্বোচ্চ দুইজন দেখা করতে পারবেন। জেল কোড অনুযায়ী সাক্ষাৎ যেন কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হয়, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সাক্ষাৎকারের জন্য যারা আসবেন, তারা রুমে প্রবেশের আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ভেতরে প্রবেশ করবেন। এছাড়া মূল গেটে নির্দেশ দেওয়া আছে, দৃশ্যমানভাবে অসুস্থ কোনও সাক্ষাৎপ্রার্থী এলে তাদের ভেতরে আসতে না দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আদালতে বন্দিদের আনা-নেওয়া করার জন্য একাধিক প্রিজন ভ্যানের ব্যবস্থা করার জন্য জননিরাপত্তা বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান কারা অধিদফতরের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে, একাধিক প্রিজন ভ্যানের ব্যবস্থা করার জন্য। কারণ একটি প্রিজন ভ্যানে বন্দি আনা-নেওয়া করলে অনেক ভিড় হয়। একাধিক ভ্যান থাকলে সেটা কম হবে।
বন্দিদের পাশাপাশি কারাগারে কর্মরতদের সুরক্ষার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মঞ্জুর হোসেন। তিনি বলেন, আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে থার্মাল স্ক্যানার চেয়েছি। সেগুলো পেয়ে গেলে আরও দ্রুত কাজ করতে পারব। ডিউটি অবস্থায় যেসব কারারক্ষী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী ভেতরে প্রবেশ করবে, তাদের প্রত্যেককে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তারা সেগুলো পালনও করছে।
বন্দিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিটি কারাগারে ভিটামিন সি জাতীয় খাবার দেওয়া হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন