দেবব্রত চৌধুরী লিটন:
মহামারি আকারে সংক্রামক রোগ দেখা দিলে এটি যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে নতুন নভেল করোনাভাইরাস। প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণা করা হয়েছিল, ভাইরাসের উৎস-ভূমি চীনে এর বিস্তার সীমাবদ্ধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু তা মোটেও করা যায়নি। বর্তমানে বিশ্বের ১৯৯টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাস। ক্রমে বেড়েই চলেছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। শনিবার (২৮ মার্চ) দুপুর পর্যন্ত প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৫ জন। এ পর্যন্ত ২৭ হাজার ৩৬০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রাণঘাতী করোনা। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬০ জন। এই তথ্যটি জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। লক-ডাউন, সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টিসহ নানা উপায়ে উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়া করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা চলছে সারা বিশ্বে। বিশেষজ্ঞরা আভাস দিচ্ছেন, করোনা বিশ্বে একটি দীর্ঘস্থায়ী ভাইরাস হিসেবে টিকে থাকতে পারে। মৌসুমি রোগের মতো এটি ফিরে ফিরে আসতে পারে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। আইইডিসিআর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীকে অবহিত করার পাশাপাশি করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতন করার কাজ করে চলছে নিয়মিত।
সংক্রামক রোগের জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের বিধি বিধানে কী আছে জানতে গিয়ে দেখা যায়- দেশের জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৬১ নং আইন) প্রবর্তন করা হয়। এই আইনে রয়েছে মোট ৩৫টি ধারা।
সংক্রামক রোগ আইন ২০১৮ এর ৪ ধারা অনুযায়ী সংক্রামক রোগের অন্তর্ভুক্ত- ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়াসিস, ডেঙ্গু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এভিয়ান ফ্লু, নিপাহ, অ্যানথ্রাক্স, মারস-কভ (MERS-CoV), জলাতঙ্ক, জাপানিস এনকেফালাইটিস, ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, শ্বাসনালির সংক্রমণ, এইচআইভি, ভাইরাল হেপাটাইটিস, টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য রোগসমূহ- টাইফয়েড, খাদ্যে বিষক্রিয়া, মেনিনজাইটিস, ইবোলা, জিকা, চিকুনগুণিয়া, এবং সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ঘোষিত কোনো নবোদ্ভূত বা পুনরুদ্ভূত (Emerging or Reemerging) রোগসমূহ।
সংক্রামক রোগের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিস্তার হতে জনগণকে সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে রোগসমূহ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সতর্কতা জারি ও পারস্পরিক সহায়তার সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এতদসংক্রান্ত শিক্ষা বিস্তার, রোগের উন্নতি পর্যালোচনা, অধিকার সংরক্ষণসহ অন্যান্য পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) কর্তৃক, প্রকাশিত এবং তপশিলে উল্লিখিত International Health Regulations, প্রয়োজনীয় অভিযোজনসহ, সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে বলে এই আইনের ৯ ধারায় উল্লেখ রয়েছে।
রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদির বিষয়ে এই আইনের ১৩ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর এইরূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদিতে উক্ত রোগের জীবাণু রয়েছে তাহলে তিনি, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, উক্ত দ্রব্যাদি বিশুদ্ধ বা ধ্বংস করিতে পারিবেন।
রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে সাময়িক বিচ্ছিন্নকরণের বিষয়ে সংক্রামক রোগ আইন ২০১৮ এর ১৪ ধারায় বলা হয়েছে- যদি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর এইরূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, কোনো সংক্রমিত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করা না হলে তার মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, সাময়িকভাবে অন্য কোনো স্থানে স্থানান্তর বা জনবিচ্ছিন্ন করা যাবে।
মৃতদেহের দাফন বা সৎকারের বিষয়ে এ আইনের ২০ ধারার (১) উপ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন বা করেছেন বলে সন্দেহ হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তির মৃতদেহ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীর নির্দেশনা মোতাবেক দাফন বা সৎকার করিতে হইবে। (২) উপ ধারায় বলা হয়েছে- এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়াদি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
এই আইনের ২৪ ধারায় সংক্রামক রোগের বিস্তার এবং তথ্যগোপনের অপরাধ ও দণ্ডের বিধান বলা হয়েছে। এই ধারার (১) উপ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তার নিকট গোপন করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। (২) উপ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ মাস কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এই আইনের অধীন সংঘটিত কোনো অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও আপিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির বিধানাবলি প্রযোজ্য হইবে বলে ২৭ ধারায় বলা হয়েছে। ২৮ ধারায় অপরাধের অ-আমলযোগ্যতা, জামিনযোগ্যতা ও আপোষযোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য (Non-cognizable), জামিনযোগ্য (Bailable) এবং আপোষযোগ্য (Compoundable) হবে।
এছাড়াও বাংলাদেশের বিদ্যমান দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর চতুর্দশ অধ্যায়ে জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সুবিধা, শোভনতা ও নৈতিকতা সংক্রান্ত অপরাধ সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে ধারা ২৬৮ থেকে ২৯৪খ ধারায়। এরমধ্যে ধারা ২৬৯ তে বলা হয়েছে- কোন ব্যাক্তি যদি বেআইনীভাবে বা অবহেলামূলক ভাবে এমন কোন কার্য করে যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোন রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও তা করে, তবে সেই ব্যক্তি ৬ মাস পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এই ধারার পরের ধারা অর্থাৎ ২৭০ ধারায় বলা হয়েছে- কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন বিদ্বেষমূলক কার্য করে, যা জীবনবিপন্নকারী মারাত্মক কোন রোগের সংক্রমণ বিস্তার করতে পারে এবং সে কার্য করার দরুন যে অনুরূপ রোগের সংক্রামণ বিস্তার হতে পারে তা জানা সত্ত্বেও তা করে তবে সে ব্যক্তি ২ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
লেখক: অ্যাডভোকেট দেবব্রত চৌধুরী লিটন, আইনজীবী, জজ কোর্ট, সিলেট।
ইমেইল- debobrothaliton@gmail.com