রাজীব কুমার দেব:
আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচার অনুশীলনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ আইনে জখমী এজাহারকারীর ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড না করার একটি রীতির প্রচলন লক্ষণীয়। অর্থাৎ এজাহারকারী নিজেই যদি জখমী হন অর্থাৎ তিনি ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল বা ঘটনাটি নিজ চক্ষে দেখে থাকেন এমন ব্যক্তি হন তাহলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করার প্রয়োজন নাই মর্মে রীতি প্রচলন আছে।
প্রচলিত এ রীতির কারণ হিসেবে যুক্তি দেখানো হয় –
ক) যেহেতু ২২ ধারায় উল্লিখিত ব্যক্তি বা জখমী ঘটনার সময় যা দেখেছে তা সে এজাহারে লিখেছে সেহেতু তার বক্তব্য পুনরায় জবানবন্দি হিসেবে রেকর্ড করার কোন প্রয়োজন নেই।
খ) সে যদি এজাহারকে সমর্থণ না করে জবানবন্দি দেয় বা তার জবানবন্দির বক্তব্য যদি এজাহার কে ডেভিয়েট করে তাহলে তা মামলার মেরিট কে আঘাত করবে।
গ) এজাহার ও জবানবন্দির পার্থক্য মামলার তদন্তে ও বিচারের উপর ভবিষ্যতের আশংকা সৃষ্টি করবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ২২ ধারার বিধান অনুসারে এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধের তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল বা ঘটনাটি নিজ চক্ষে দেখেছেন এমন কোন ব্যক্তির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করবার জন্য অনুরোধ করেন, তাহলে ক্ষমতাসম্পন্ন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত ব্যক্তির জবানবন্দি গ্রহণ করবেন এবং গৃহীত জবানবন্দি তদন্ত প্রতিবেদনের সাথে সামিল করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবার নিমিত্ত তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট সরাসরি প্রেরণ করবেন৷
উল্লেখ্য এই ধারার বিধান মতে বিচারকালে বিশেষ কিছু কারণে জবানবন্দি প্রদানকারী ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার জবানবন্দি মামলায় সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা যাবে। ২২ ধারার জবানবন্দি রেকর্ডের সুপ্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে এই আইনে ঘটনা সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা চাক্ষুষ ব্যক্তির বক্তব্যকে জবানবন্দি আকারে আইনি ফ্রেম দেওয়া এবং বিচারকালে উক্ত জবানবন্দি কে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা। তাছাড়া মিথ্যা অভিযোগ দায়ের কে এই আইনে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মূল ধারা, মূল ধারা হতে অনুসৃতঃ চুলছেড়া বিশ্লেষণ এবং ২২ ধারার সুপ্ত উদ্দেশ্যের আলোকে আলোচ্য বিষয় টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় –
প্রথমতঃ- ২২ ধারায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট কে জবানবন্দি রেকর্ডের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা তার বিবেচনাধীন বা ইচ্চাধীন ক্ষমতা নয় অর্থাৎ বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট জবানবন্দি প্রদানের উদ্দেশ্যে এই ধারায় উল্লিখিত ব্যক্তিকে হাজির করানো হলে তিনি তা রেকর্ড করবেন- এটি আইনি বাধ্যবাধকতা।
দ্বিতীয়তঃ- জবানবন্দি গ্রহণ না করার পক্ষে যদি যুক্তি দেখানো হয় যে, এই ধারায় ‘অপরাধের ত্বরিত বিচারের স্বার্থে কোন ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক অবিলম্বে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন’ শব্দাবলী সন্নিবেশ থাকায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ইচ্ছা করলেই স্ব-বিবেচনায় হাজিরকৃত ব্যক্তির জবানবন্দি গ্রহণ নাও করতে পারেন। না, আইনের উল্লিখিত শব্দাবলী তদন্তকারী কর্মকর্তা কে ইংগিত করেছে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটকে নয়। অর্থাৎ জখমী কে (যে কিনা এজাহারকারীও) জবানবন্দি রেকর্ডের নিমিত্তে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুরোধ করবেন কিনা তা তদন্তকারী কর্মকর্তার বিষয়। সুতরাং বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের জখমী ব্যক্তি এজাহারকারী বিবেচনায় তার জবানবন্দি গ্রহণ হতে বিরত থাকা উচিত হবে না।
তৃতীয়তঃ- জবানবন্দি গ্রহণ না করার পক্ষে যদি আশংকা করে যুক্তি দেখানো হয় যে, জখমী এজাহারকারী এজাহারকে সমর্থণ করে জবানবন্দি না দিলে মামলার মেরিট কে আঘাত করতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশের পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অধিকাংশ সময়ে এজাহার একটি ‘প্যাকেজ ডিলিংস’ এ পরিণত হয় এবং মূল অভিযোগের পাশাপাশি কিছু আ্যন্সিলারী অভিযোগ আনা হয় যা মূল ঘটনা কেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। এজাহারকারী ২২ ধারার জবানবন্দিতে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে জবানবন্দি এজাহারকে সমর্থণ না করলেও সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে সহায়তা করে। আর মামলার মেরিট কে আঘাত করবে মর্মে যে আশংকা তা Preconceived ও Misconceived Judicial mind হতে অনুসৃতঃ। কেননা তদন্ত পরিচালনা কালে রেকর্ডকৃত জবানবন্দি ঘটনার প্রকৃত সত্য নিরুপণে সহায়তা করে এবং অনেক সময় প্রকৃত সত্য বের করে নিয়ে আসে। যেমন – এজাহারকারী এজাহারে ধর্ষণের অভিযোগ করল কিন্তু তার ২২ ধারার জবানবন্দিতে সে নিজেকে সন্তোষজনক ভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে পরিচয় দিল এবং অভিযুক্তের সাথে তার সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছে এবং একসাথেই সংসার করছে অথচ তার পরিবার তাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দায়েরে তাকে বাধ্য করিয়েছে এবং সে অভিযুক্তের সাথেই সংসার করতে চায় মর্মে তথ্য দিল। এইক্ষেত্রে এজাহারকারীর ২২ ধারা জবানবন্দি ঘটনার সত্যতা নিরুপণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া উক্তরুপ অসমর্থণ মামলার মেরিট কে আঘাত করবে কিনা তা মাননীয় বিচারিক আদালতের বিবেচনার বিষয় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নয়।
চতুর্থতঃ- এজাহারকারী এজাহারে শুধুমাত্র অভিযোগ আনয়ন করেন কিন্তু তিনি জবানবন্দি তে শুধুমাত্র তথ্য দিয়ে থাকেন কোন অভিযোগ নয়। আর যদি তিনি জবানবন্দি তে নতুন তথ্য দেন তাহলে তা ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে তদন্তে সহায়তা করবে। আর তথ্য সংগ্রহ তদন্তের মৌলিক কাজ এবং আইনের কাঠামোগত দিক বিবেচনায় তদন্তে সহযোগিতা করা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব তিনি কিন্তু জখমী ব্যক্তি এজাহারকারী এই যুক্তিতে তার জবানবন্দি গ্রহণে অস্বীকার করা উচিত হবে না।
পঞ্চমতঃ- যদি যুক্তি দেখানো হয় যে, বিচারিক পর্যায়ে এজাহারকারী একবার এজাহারকারী হিসেবে আরেকবার ২২ ধারার সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি প্রদান অনুচিত হবে। কিন্তু উচিত বা অনুচিত তা মাননীয় বিচারিক আদালতের বিবেচনার বিষয় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নয়।
ষষ্ঠতঃ- এজাহার ও ২২ ধারার জবানবন্দি পৃথক রেকর্ডপত্র এবং উভয়ের আইনি অবস্থান ও আইনি মর্যাদা সম্পূর্ণ আলাদা এবং সাক্ষ্যগত মূল্য ভিন্নমাত্রিক। তদবিবেচনায় ২২ ধারায় জখমী এজাহারকারীর জবানবন্দি গ্রহণ না করা উচিত হবে না।
সপ্তমতঃ- জখমীর মেডিকেল সনদ ও তার পূর্বের প্রদত্ত জবানবন্দি মামলা প্রমাণের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই জবানবন্দি গ্রহণ না করলে মামলা প্রমাণের বিচারিক বাধার সামিল হতে পারে৷
অষ্টমতঃ- বিচারিক পর্যায়ে এজাহারকারী এজাহারের সমর্থণে জবানবন্দি দিবেন আর বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দির রেকর্ডের সমর্থণে জবানবন্দি দিবেন। এজাহার ও জবানবন্দি তে পার্থক্য হলে তা বিচারিক পর্যায়ে রায়ের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে। সুতরাং এজাহার কে ডেভিয়েট করতে পারে এই যুক্তিতে এজাহারকারীর জবানবন্দি গ্রহণ না করা উচিত হবে না।
নবমতঃ- সর্বোপরি জখমী ব্যক্তি এজাহারকারী হলে জবানবন্দি রেকর্ড করতে হবে না তদ সমর্থণে কোন আইন বা উচ্চাদালতের সিদ্ধান্ত আমার জানা নেই।
সার্বিক বিশ্লেষণে জখমী ব্যক্তি এজাহারকারী হলেও আইনি বাধ্যবাধকতায় ঘটনার সত্যতা নিরুপণে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের ২২ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণের অনুরোধ ফেরত দেওয়া উচিত হবে না।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।