কাজী শরীফ:
আইনজীবী বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে কচকচে টাকা, গাড়ি, বাড়ি, প্রাচুর্যপূর্ণ জীবন। আমরা খুঁজি না এর পেছনে লেগে থাকা অন্তত দুই যুগের শ্রম। অন্তত দুই যুগ (বাস্তবে আরো বেশি সময় লাগে) দিবারাত্রি পরিশ্রমের পর আমার লেখার প্রথম লাইনের দেখা একজন আইনজীবীর জীবনে মেলে।
আমরা যারা আইনজীবী নই তারা বিবেচনায় নিই না এর পেছনে কত শত নির্ঘুম রাত আছে, খোঁজ নিই না কতশত দুপুরের খাওয়া না খাওয়ার গল্প আছে, আমরা অনেকে জানিও না একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর প্রতিটি মুহুর্তের কষ্ট।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দেশের সরকারি বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একজন আইনের ছাত্র যখন একজন জেষ্ঠ্য আইনজীবীর অধীনে থেকে দিনে দেড় দুইশত টাকা উপার্জন করছেন তখন তার অন্য বিষয়ে পড়া বন্ধুটি কোন না কোন চাকুরি কিংবা ব্যবসায় নিযুক্ত হয়ে মাস শেষে সম্মানজনক উপার্জন করছেন। নিজে যেমন সে আয় দিয়ে চলছেন তেমনি পরিবারে রাখতে পারছেন অগ্রণী ভূমিকা।
অপরদিকে শিক্ষানবিশ আইনজীবীর গল্প হয় পুরোপুরি উল্টো। সকালে ঘুম থেকে উঠে চেম্বারে যেতে হয় সাড়ে আটটার মধ্যেই। কতদিন নাস্তা না করে বাসা থেকে বের হতে হয় তার হিসেব রাখা অসম্ভব। সাড়ে দশটার মধ্যে আদালতে উপস্থিত থাকতে হয়। একই সাথে অনেকগুলো আদালতের কার্যক্রম চলায় সিনিয়রকে জানান দিতে হয় নিজেদের মামলা আসার প্রাক্কালেই। এ কাজের ফাঁকে কিছু মুখে পুরে নেয়ার সময় কোথায়? দুপুরে একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর সঙ্গতকারণেই হোটেলে খেতে হয়। এত সকালে ঘুম থেকে উঠে টিফিন ক্যারিয়ারে করে ভাত আনা প্রায় অসম্ভব। তাও সম্ভব হতো যদি খাবার জন্য আইনজীবীদের জন্য ডাইনিং রুম থাকতো কিংবা বাসায় সাহস করে মাকে টিফিনের কথা বলতে পারতো!
যে বয়সে একজন মানুষ সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার কথা সেসময় হাত খরচের টাকা যখন পরিবার থেকে নিতে হয় তখন শিক্ষানবিশ আইনজীবীটির বাসা থেকে ভাত আনার কথা বলার মুখ থাকে না! তাই আমৃত্যু একজন আইনজীবীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে গ্যাস্ট্রিকের ব্যারাম!
এদেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নন সেহেতু এদেশের অধিকাংশ শিক্ষানবিশ আইনজীবীর পরিবারও এ হিসেবের বাইরে পড়েন না। ছেলে বা মেয়েকে আইনে ভর্তি করিয়ে তৃতীয় বর্ষ থেকেই “আর কতদিন লাগবে লেখাপড়া শেষ করতে” এ ধরণের প্রশ্ন বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষা করেন ও উত্তরদাতা এইতো আর দু’বছর বলে কোনরকম স্থান ত্যাগ করেন। কিন্তু সে দুই বছর (স্নাতক পরীক্ষার পর) ৬ মাসের শিক্ষানবিশকাল, প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষার যাঁতাকলে পড়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িতই হয়! দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন সে পরীক্ষাগুলোও ঠিক সময়ে হয়না। সুতরাং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পরও একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর শরীর থেকে শিক্ষানবিশের তকমা যেমন কাটেনা তেমনি গলা থেকে শিক্ষানবিশদের জন্য নির্ধারিত লাল টাইও নামেনা!
একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর পুরোদিনের বর্ণণা করতে গেলে এ লেখার দৈর্ঘ্য পাঠকের সহ্যসীমা অতিক্রম করবে নি:সন্দেহে। সারাদিনে আদালত পাড়ায় তার যা খরচ হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি যে বিজ্ঞ আইনজীবীর অধীন শিক্ষানবিশকাল অতিক্রম করছেন তিনি তাও প্রদান করেন না। উল্লেখ্য বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী যখন শিক্ষানবিশ ছিলেন তখন তার অবস্থা আরো কঠিন ছিলো! তাই তিনিও এ বলয় থেকে বের হতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে বরেণ্য অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক সালাউদ্দিন লাভলুর নতুন বউ নাটকের কথা মনে পড়ছে। সে নাটকে শ্বাশুড়ি চরিত্র রুপদানকারী ওয়াহিদা মল্লিক জলি তার পুত্রবধূ শ্রাবস্তী দত্ত তিন্নিকে খুব যন্ত্রণা দেন। কারণ তার শ্বাশুড়ি তাকে কষ্ট দিতেন। দুই বেলা দু’মুঠো খেতেও পারতেন না। তাই বউয়ের এত সুখ তার সহ্য হয় না! নাটকের শেষ দৃশ্যে শ্বাশুড়ির ভুল বুঝতে পারা দেখায়। আমাদের সিনিয়র আইনজীবীরা সে নাটকটি কী সময় করে দেখবেন!
করোনার এ দু:সময়ে আমাদের সিনিয়র আইনজীবীরা কি তাদের সন্তানতুল্য নিজ নিজ চেম্বারের জুনিয়রদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন না? প্রয়োজনে ঋণ হিসেবে দিন তবু একজন ভবিষ্যত আইনজীবী কিংবা নবীন আইনজীবী (যিনি আপনার সহকর্মীও বটে) আত্নসম্মান নিয়ে বাঁচুক এটা কী আপনি চান না!
লেখক- সহকারী জজ, নোয়াখালী।