হাসান তারিক পলাশ:
কোভিট-১৯ এর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে লক ডাউন। মেডিকেল সেবা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার ছাড়া কার্যত সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সহ দেশের সকল পর্যায়ের আদালত বন্ধ রয়েছে। অথচ মেডিকেল সেবার মতই মানুষের ন্যায়বিচার পাবার অধিকার সার্বজনীন এবং যেকোনো অবস্থার প্রেক্ষেতেই হোকনা কেন এই অধিকার এক মূহুর্তের জন্যও স্থগিত করা যায় না।
অন্যদিকে, কোভিট-১৯ যেভাবে মহামারী আকার ধারণ করেছে সেপ্রেক্ষিতে আদালতের প্রচলিত কার্যক্রম চালু রাখাও সম্ভব নয়। অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি যথার্থই প্রচলিত আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন এবং বিগত ১১ মার্চ, ২০২০ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক আদেশ বলে “সীমিত পরিসরে” আদালত চালুর সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছেন।
অথচ বিচার পাবার অধিকার থেকে নাগরিকদের এক মুহুর্তের জন্যও বঞ্চিত করা যাবেনা। লক ডাউন যদি দীর্ঘমেয়াদী হয় তবে প্রচলিত আদালতের কার্যক্রম সম্পুর্ন ভেংগে যাবে এবং বিচার পাবার অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমরা টেকনোলজির সহায়তা নিতে পারি।
এই ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছে ভারতের কেরালা হাইকোর্ট। বিগত ৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখ কেরালা হাইকোর্ট ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে শুনানি গ্রহণ করে জরুরি রিট এবং জামিন সহ প্রায় ৩০ টি ম্যাটার নিষ্পত্তি করেছেন। মাননীয় বিচারপতিগন বাসায় থেকে এবং আইনজীবীগন যার যার নির্ধারিত চেম্বার বা বাসায় থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিয়েছেন। কেরালা হাইকোর্টের পরে রাজস্থান হাইকোর্ট সহ একাধিক ভারতীয় হাইকোর্ট এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
এই বাস্তবতার নিরিখে ভারতের প্রধান বিচারপতি একটি সার্কুলার জারি করেছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জরুরী বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার জন্য বিচারপতি মি. এস.এ ববডি লকডাউনের সময় এখতিয়ার সম্পন্ন বেঞ্চ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। উক্ত সার্কুলার অনুযায়ী জরুরী বিষয়গুলো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার জন্য “ই ফাইলিং সিস্টেম” কাজে লাগানোর জন্য আইনজীবীদের নির্দেশনা প্রধান করা হয়েছে।
লকডাউন দীর্ঘমেয়াদী হোক বা নাহোক, ভারতের এই নজির আমাদের দেশে গ্রহণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশের বিচারপদ্ধতি যেহেতু জটিল প্রসেস নির্ভর সেহেতু প্রসেস বা পদ্ধতিকে সহজতর করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে :
১. প্লিডিংস এর জন্য নির্ধারিত ফরম (Prescribed Form)- পিটিশন, আরজি, জবাব, রিপ্লাই ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা কলাম করে ফরম তৈরি করা যেতে পারে।
এই ফরমে পক্ষদের নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার, ই মেইল, আইনজীবীর ই মেইল, সংশ্লিষ্ট আইন এবং নির্দিষ্ট ধারা, নজির, ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, আদালতের এখতিয়ার, তামাদি, কোর্টফি, ডকুমেন্টস এর স্কান কপি/এক্সিবিট এবং প্রার্থনার আলাদা আলাদা কলাম থাকবে।
২. কোর্টফি প্রদান : বিকাশ বা অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে কোর্টফি প্রদান করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে টাকা জমাদেবার স্লিপটি স্কান করে ই ফাইলিং এ যুক্ত করা যেতে পারে।
৩. এভিডেভিড/নোটিশ : আদালতের সার্ভারে প্রতিটি ম্যাটারের জন্য আলাদা আলাদা ফাইল পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে লক করা থাকবে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বা পক্ষ উক্ত পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে প্রবেশ করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজেকে ভেরিফাই করে নিবেন।
৪. নোটিশ সার্ভিস : পক্ষদের মাঝে কোন নোটিশ সার্ভিস করতে হলে প্লিডিংসে উল্লেখিত ভেরিফাইড ই মেইলে নোটিশ সার্ভ করা যেতে পারে। নোটিশ সার্ভ করে পক্ষের নির্ধারিত মোবাইলে নোটিফিকেশন পাঠানো যেতে পারে।
৫. শুনানি: ভিডিও কনফারেন্সে শুনানির সময় মাননীয় বিচারপতি এবং আইনজীবীগন প্রচলিত আদালতের সকল বিধিমালা অনুসরণ করবেন। উভয় পক্ষই নির্ধারিত পোশাক পরে ক্যামেরার সামনে উপস্থিত হবেন।
শুনানির সময় আইনের রেফারেন্সের ক্ষেত্রে অনলাইন এবং প্রচলিত রেফারেন্স ব্যবহার করা যাবে। কোন রেফারেন্স এর অনলাইন ভার্সন না থাকলে আইনজীবীগন স্কান করে মাননীয় বিচারপতির সামনে উপস্থাপন করবেন।
৬. রায় প্রদান: রায় এবং আদেশ আদালতের সার্ভারে আপলোড করে পক্ষদের ইমেইলে প্রেরণ করা যেতে পারে। ই মেইলে প্রেরণ করে মোবাইলে নোটিফিকেশন পাঠানো যেতে পারে।
৭. আপীল/রিভিশন: যেহেতু আদালতের সার্ভারে পূর্নাঙ্গ মামলার নথি আপলোড করা থাকবে সেহেতু আপিল বা রিভিশনের ক্ষেত্রে রায় বা আদেশের সার্টিফাইড কপির প্রয়োজন হবে না।.. আইনজীবীগন আপীল মেমো বা রিভিশন পিটিশন তৈরি করে নির্ধারিত পদ্ধতিতে মুল মামলার ফাইলে যুক্ত করে দিবেন।.. আপীল বা রিভিশনাল আদালত মুল ফাইলে ঢুকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানি নিয়ে আপীল বা রিভিশন নিষ্পত্তি করে দিবেন।
এগুলো সবই প্রস্তাব।… মাননীয় বিচারপতিগন, বারের নেতৃবৃন্দগন, সিনিয়র আইনজীবীগন তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের আলোকে একটা কার্যকর পদ্ধতি তৈরি করে দিতে পারেন।
লক ডাউন দীর্ঘমেয়াদি হোক বা না হোক জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে ভিডিও কনফারেন্স এবং ই কোর্ট সিস্টেম একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।.. আর লকডাউন যদি দীর্ঘমেয়াদী হয় তবে ভারতের মত এই পদ্ধতি আমাদের অনুসরণ করতেই হবে।.. জনগণ যদি এক মুহুর্তের জন্য বিচার প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তবে সেটি সংবিধান এবং মানবাধিকার লংঘন হিসাবে বিবেচিত হবে।
বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ করছি।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।