শায়লা জাহান:
সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বৈশ্বিক এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে সামনের সারিতে যারা নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারাও আজ গণহারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই দূর্যোগ মনে করিয়ে দিল যে হেলথ প্রফেশনালদের নিরাপত্তার জন্য কোন নীতিমালা আমাদের দেশে আছে কিনা বা এধরনের প্যান্ডেমিক অবস্থা সৃষ্ট হলে কি ধরনের সাবধানতা আগে থেকে নেয়া উচিৎ। এক্ষেত্রে সরকার ডাক্তার, নার্সদের জন্য সাস্থ্য বীমা, আর্থিক প্রণোদনাসহ নানাবিধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তবে তা এই মহামারী পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যই। কিন্তু এর বাইরে তাকালে দেখা যায় এই নোবেল পেশায় যারা আছেন তাদের সুরক্ষার ব্যাপারে বিশেষ আইন প্রনয়ণে দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে।
দেখা যায় যে হাসপাতালের যখন কোন রোগীর অবহেলাজনিত মৃত্যু হলে কি ভয়ংকর আক্রমণ করা হয় চিকিৎসক নার্সদের উপর। কোন রকম আইনের তোয়াক্কা না করে তদন্তের বাইরে গিয়ে হাসপাতালে ভাংচুর, কটুক্তি, ডিউটিরত ডাক্তার নার্স এর উপর শারীরিক আক্রমণ, অকথ্য ভাষা প্রয়োগ হরহামেশাই ঘটে। ফলশ্রুতিতে চিকিৎসক কর্তৃক অনির্দিষ্ট ধর্মঘট, জরুরী সেবা প্রদান থেকে বিরত থাকা সেই সাথে একযোগ হয়ে অন্যান্য হসপিটালে কর্মবিরতি আর পুলিশ তখন বিশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য লাঠিচার্জ, অবৈধ আটক ইত্যাদি প্রজননগত অধিকার প্রয়োগ করে থাকে। চিকিৎসক এবং রোগীর তত্তাবধানকারীর মধ্যে এরকম সংঘর্ষ প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি সাধন তদ্রূপ সরকারি বেসরকারি হসপিটালের কার্যক্রম বন্ধ কোন ভাবেই কাম্য হতে পারেনা। ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশনের গবেষণা মতে সেখানে শতকরা ৭৫ শতাংশ চিকিৎসক পেশাগত দায়িত্ব পালনে ভায়োলেন্সের শিকার হন। আমাদের দেশেও চিকিৎসক, নার্স, সাস্থ্যকর্মী শারিরীক ভাবে হামলার শিকার হন কিন্তু এসব সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশে মেডিকেল এসোসিয়েশন এর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম দেখা যায় না।
প্রসংগত অবহেলার ফলে মৃত্যু সম্পর্কে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ ক ধারায় শাস্তির বিধান আছে। এছাড়াও অবহেলা জনিত কাজের জন্য ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা বিপন্ন হলে দণ্ডবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ধারায় শাস্তির বিষয়ে বলা আছে। হেলথ সার্ভিস প্রভাইডার এর গাফেলতির বিরুদ্ধে লিগ্যাল রেমেডি আদায় করা সম্ভব। আর রোগী তথা ব্যাক্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সাংবিধানিক অধিকার তো রয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এ্যাক্ট, ২০১০এ বলা আছে কোন মেডিকেল প্র্যাকটিশনার, ডেন্টিস্ট এর পেশাগত অসদাচরণ বা রোগীকে গুরতর অবহেলা করলে কাউন্সিল অভিযোগ আমলে নিয়ে উক্ত ব্যাক্তিকে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে সাময়িক সাসপেন্সন বা রেজিস্ট্রার থেকে তার নাম কর্তন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। দুঃখজনক ব্যাপার হল যে এই চিকিৎসক, সাস্থ্যকর্মী যখন অনাকাঙ্ক্ষিত ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছেন যেখানে ক্রিটিকাল রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে হেনস্তার কবলে পড়ছেন তার প্রতিকার কিন্তু সহজে পাচ্ছেন না। জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এধরনের রিপোর্ট আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। সূতরাং মেডিকেল হেলথ সার্ভিস এ নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স, সাস্থ্য কর্মীদের উপর এরুপ আক্রমণকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি তৈরী হয় তা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না স্পেশাইলাইজড আইন নেই বলে।
ভারতে Prevention of Violence and Damage to Property Act আইনটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এই আইনে মেডিকেল প্র্যাকটিশনার, ডেন্টিস্ট, নার্স, হেলথ্ ইন্সটিটিউট এর নিরাপত্তা এধরনের অপরাধে জড়িতদের জন্য জেল-জরিমানার বিধান করা হয়েছে। চীনের বেইজিং হসপিটালে কিছু দিন আগে একজন ডাক্তারকে ডিউটিরত অবস্থায় ছুরিকাঘাত করার পর ডক্টরস সেফটি এ্যাক্ট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যেখানে হেলথ প্রফেশনালদের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা, পেশাগত সম্মান নিশ্চিতকরন কোন ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক হুমকি প্রদর্শন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এরূপ কাজ এবং প্রতিষ্ঠানের হেলথ কেয়ার সিস্টেম ইনফরমেশন রিসিভ, এর অবৈধ ব্যবহার ও প্রকাশ ইত্যাদির শাস্তি জেল-জরিমানা রাখা হয়েছে। World Medical Association এর প্রোটেকশন অফ হেলথ প্রফেশনাল বিষয়ক সুপারিশগুলো অনুসরণ করে বাস্তবিক আইন প্রণয়ন করা দরকার। মেডিকেল ম্যাল প্র্যাক্টিস পৃথিবীর অনেক দেশেই হয় এটা সত্যি। আবার অহেতুক অভিযোগ এনে চিকিৎসককে লাঞ্চিত হতে দেখা যায় যা অগ্রহণযোগ্য। সেই চিকিৎসক আবার হুমকি, কটুক্তি, মানসিক চাপ নিয়ে কোয়ালিটি সেবা দিবে এমন ভাবনা থেকে বের হয়ে আসা উচিৎ।
আমাদের দেশে চিকিৎসক সুরক্ষা আইনের খসড়া প্রস্তাবিত হয়েছে অনেক আগেই। এই আইনে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত সকলের নিরাপত্তা, হেলথ্ ইস্যু নিয়ে অভিযোগ থেকে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা দমন, জরুরী সেবা কার্যক্রম চালু রাখা, চিকিৎসক নার্স এর সাথে রোগীর সম্পর্কন্নোয়ন, রোগীদের মধ্যে অবহেলা বিষয়ক সচেতনতা বাড়ানো, গুরতর অবহেলা হলে তা অপরাধ হিসেবে আখ্যায়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ধারা সন্নিবেশিত হয়েছে। এই আইন অনুমোদন হলে রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য আশাব্যঞ্জক হবে বলে মনে করি। বিচার পদ্ধতিকে তরান্বিত করার জন্য অপরাধ বিষয়ক সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয়তা কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হেলথ সেক্টর হচ্ছে রাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ যেখানে উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যেমন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার ঠিক তেমনই এই মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে হেলথ প্রফেশনালরা হুমকির বর্শবর্তী না হয়ে নিরাপত্তা, সতর্কতা, উৎসাহ নিয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে যাবে এমনটাই হওয়া উচিৎ।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।