মো. জিয়াউর রহমান :
শুরু করছি কনফুসিয়াস এর একটি উক্তি দিয়ে, “Return Good For Good, Return Evil with Justice”. মহাপ্রাচীরের দেশ চীন, কনফুসিয়াস এর দেশ চীন, মাও সেতুং এর দেশ চীন। ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও’ – এই পবিত্র উক্তির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। চীন আমাদের উন্নয়নের বড় অংশীদার, দ্বিপাক্ষিক বন্ধু। আমাদের চেয়ে চায়না ৬৫ গুণ বড় দেশ, লোকসংখ্যা ৯ গুণ বেশী। করোনার অনাকাঙ্খিত অখন্ড অবসরে আসুন, বন্ধু রাষ্ট্র চীনের বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান শাস্তিগুলোর সাথে পরিচিত হই।
একটু পেছনে ফিরে যাই। চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সনে। কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ক্ষমতায় এসে প্রচলিত সব সিস্টেম ভেঙ্গে দেয়। ভেঙ্গে দেয় প্রচলিত আইন-আদালত। আগের সিস্টেম কে বাতিল করায় ১৯৪৯ হতে ১৯৭৮ সন পর্যন্ত চীনে বস্তুতঃ কোন প্রতিষ্ঠিত আইন ব্যবস্থাই ছিল না। নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তোলার মহৎ উদ্দেশ্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সন হতে চীন Open Up Policy বা খুলে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। এরপর কমিউনিস্ট শাসনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, নতুন করে সব আইন প্রণয়নও শুরু হয়।
আমাদের মত পৃথক পৃথক আইনে পৃথক ভাবে শাস্তির বিধান চীনে নেই। Penal Code এর মত Criminal Law চীনের প্রধান আইন যেখানে সব অপরাধের শাস্তির কথা বলা আছে। শাস্তি সব এই এক আইনের অধীন। যেমন ধরুন আলাদা মিলিটারি ল আছে, কিন্তু মিলিটারি ল’তে শাস্তি বলা নাই, বলা আছে ওই Criminal Law তে। সে হিসেবে ওদের শাস্তির বিধানওয়ালা Criminal Law অনেক গোছানো ও পূর্ণ। সাধারণ ভাবে, শাস্তিকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়- ১. Principal Punishment বা মূখ্য শাস্তি ও ২. Supplementary Punishment বা অনুগামী শাস্তি। মূখ্য শাস্তির সাথে অনুগামী শাস্তি যুক্ত হতে পারে আবার নাও পারে। আমাদের দেশে Fine বা অর্থদন্ড বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল শাস্তির অনুগামী শাস্তি। চায়নার ক্রিমিমাল ল’তে মূখ্য (Principal) শাস্তিগুলো হলো- ১. মৃত্যুদন্ড (Death Punishment), ২. যাবজ্জীবন কারাদণ্ড (Life Imprisonment) ৩. নির্ধারিত মেয়াদ কারাদন্ড (Fixed Term Imprisonment), ৪. ফৌজদারি আটক (Criminal Detention) এবং ৫. নিয়ন্ত্রণ (Control). আর অনুগামী শাস্তি হলো ১. অর্থদন্ড (Fine) এবং ২. বাজেয়াপ্তি (Confiscation), ৩. রাজনৈতিক অধিকার হরণ (Deprivation of political right). চীনের অধিকাংশ শাস্তিই আমাদের মত মনে হলেও মজার পার্থক্য আছে, যেমন ওদের মৃত্যুদন্ড- ২ রকমের, যাবজ্জীবন-২ রকমের। নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন!
১. মৃত্যুদন্ডঃ DuiHua এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর চায়না ২০০০ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। সারাবিশ্বের সবগুলো দেশ মিলে যতগুলো মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে, চায়না করে তার দ্বিগুণের বেশী। সে কারনে চায়নার মৃত্যুদন্ড নিয়ে অনেকের কৌতুহল। চায়নার দুই রকম মৃত্যুদন্ডের একটি হলো ১. DPWIE (Death Penalty With Immediate Execution) এবং ২. DPWTYS (Death Penalty With Two Years Suspension). বুঝাই যাচ্ছে DPWTYS নমনীয় মৃত্যুদন্ড। DPWTYS এর ক্ষেত্রে দন্ডিত ব্যক্তি যদি দন্ড পরবর্তী ২ বছরে ইচ্ছাকৃত কোন অপরাধ না করে, তবে তার শাস্তি যাবজ্জীবন হিসেবে কনভার্ট হবে এবং যদি তার কোন বড় জনকল্যাণকর কাজ বা অর্জন থাকে, তাহলে সেই যাবজ্জীবন ২৫ বছর কারাদন্ডে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ আছে। তবে শাস্তি আরোপের সময় বড় অপরাধের (যেমন ধর্ষণ, ডাকাতি, অপহরণ) ক্ষেত্রে জাজ এই ধরনের Commutation এ Restriction আরোপ করতে পারে। আমাদের মত চায়নার সর্বোচ্চ আদালত Supreme People’s Court [SPC] এর কনফার্মেসন ব্যতীত কোন মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় না। DPWIE এর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দন্ডিত হওয়ার পর তাকে মৃত্যুর পথেই যেতে হয়। চায়নাতে ৭৫ সালের পর হতে কাউকে clemency দেওয়ার রেকর্ড নেই। ১৮ বছরের নিচের শিশু, ৭৫ এর উপর কোন বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী নারীকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা আইনে নিষিদ্ধ। আমাদের শিশু আইনে শিশু যত বড় অপরাধই করুক না কেন, তার শাস্তি সর্বোচ্চ দশ বছর কারাদণ্ড হতে পারে। গর্ভবতী নারীকে মৃত্যুদন্ড দিতে আমাদের আইনে কোন বাঁধা নেই, তবে গর্ভবতী নারীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরে বিধিনিষেধ আছে। আর বয়স্কদের জন্য আলাদা কোন পেনাল পলিসি আমাদের নেই।
২. যাবজ্জীবন কারাদণ্ডঃ মৃত্যুদন্ডের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে চায়নায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান। চায়নার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ২ রকমের- ১. LWOP [Life (Imprisonment) Without Parole] এবং ২. LWR [Life (Imprisonment) With Release]. LWOP কঠিন কেননা আমৃত্যু কারাগারে থাকতে হয়। আমাদের দেশে আগে যাবজ্জীবন বলতে ৩০ বছর কারাদণ্ড বুঝাতো এবং দন্ডিত রেয়াদ/ Remission পেতো। পরে মাননীয় আপীল বিভাগ ‘আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় বলে দিয়েছে, “An imprisonment for life means imprisonment for the rest of the prisoner. A convict undergoing life imprisonment has no right to claim remission.” [69 DLR (AD) 214]. ‘আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় মাননীয় আপীল বিভাগের রায়ের পর আমাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড চায়নার LWOP এর মত হয়ে গেছে যাতে দন্ডিতের মুক্তির কোনরূপ সম্ভাবনা নেই। এই রায়টি রিভিউ হয়েছে, হয়তো অল্প দিনে এ বিষয়ে রিভিউ এর রায় আমরা পাবো। LWOP আসলে মৃত্যুদন্ড না দেয়ার বিকল্প ও ভিকটিমের মানসিক শান্তির জন্য। তবে মানবাধিকার দৃষ্টিকোনে দিয়ে LWOP অনেক Rude & Inhuman Punishment যেখানে মুক্তির স্বপ্নও কেউ দেখতে পায়না। অন্যদিকে চায়নাতে LWR এর ক্ষেত্রে দন্ডিত ব্যক্তি ১৩ বছর কারাদণ্ড ভোগ করলে তার দন্ড কমতে পারে এবং প্যারোল পেতে পারে।
৩. নির্ধারিত মেয়াদ কারাদন্ডঃ এই দন্ড আমাদেরও আছে, চায়নারও আছে। আমাদের সর্বনিন্ম কারাদণ্ড ২৪ ঘন্টা হতে শুরু, একেক আইনে একেক সীমা। আর চায়নায় এই শাস্তি ৬ মাস হতে ১৫ বছর। আমাদের মতই আগের কাস্টডি পিরিয়ড বাদ দেওয়ার বিধান আছে। চায়নাতে দন্ডভোগকালীন সময়ে দন্ডিতকে পড়ালেখা ও শোধরানোর জন্য গৃহীত নানা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
৪. ক্রিমিনাল ডিটেনসনঃ ছোটখাটো অপরাধে ১-৬ মাসের শাস্তি হলো ক্রিমিনাল ডিটেনসন যা public security organ বা পুলিশ ব্যস্তবায়ন করে। রায়ের আগের হাজতবাস বাদ যাবে। Criminal Detention এর মত শাস্তি আমাদের নেই। বিশেষ ক্ষমতা আইনে Preventive Detention এর বিধান থাকলেও এখন খুব একটা চর্চা হয় না।
৫. নিয়ন্ত্রণঃ এটার সাথে আমরা পরিচিত নয়। কন্ট্রোল হলো ২ হতে ৩ মাস মেয়াদী শাস্তি যাতে কিছু অধিকার চর্চার সুযোগ থাকে না, যেমন Right to Speech, Right to Assembly, Right of Freedom of Procession.
অনুগামী শাস্তিঃ ১. Fine: অনুগামী শাস্তি হিসেবে Fine আমাদের ও চায়নাতে প্রায় এক। ভবিষ্যতে সম্পত্তি হতেও জরিমানার টাকা আদায় করা হতে পারে। যদি কেউ ফাইন এর টাকা দিতে অসমর্থ হয়, তবে ফাইন কোর্ট কমাতে পারে বা মাফ করে দিতে পারে। ২. বাজেয়াপ্তঃ অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত জিনিসপত্র, সম্পদ বা অর্থ কোর্ট বাজেয়াপ্ত বা Confiscated করতে পারে। এক্ষেত্রে বাজেয়াপ্তকৃত অর্থ হতে চায়নার আদালত অধীনস্তের বা নির্ভরশীলের মাসিক খরচ বা ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধের আদেশ দিতে পারে। এটা অনেক মানবিক বিধান। ৩. রাজনৈতিক অধিকার হরণঃ মূল শাস্তির অনুগামী শাস্তি হিসেবে Deprivation of political right চায়নাতে বহুল ব্যবহৃত। এমন শাস্তিতে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের জন্য ভোট দিতে পারবে না, নির্বাচন করতে পারবে না। বাংলাদেশে এমন শাস্তি নেই, তবে শাস্তির Consequence হিসেবে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি আমাদের এখানে নির্বাচনে অযোগ্য হতে পারে। [আর্টিকেল ৬৬(২)(d), বাংলাদেশ সংবিধান]
আমরা দেখছি, চায়নাতে প্রচলিত Control এবং Deprivation of Political Rights শাস্তি দুটো আমাদের এখানে অপরিচিত। মূলতঃ একটা দেশের রাজনৈতিক কালচার, রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা অনুযায়ী আইন- আদালত গঠন ও পরিচালিত হয়, দন্ডের প্রয়োগ হয়। চায়নাতে কমিউনিস্ট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। সেখানে একটাই দল এবং পার্টির সিদ্ধান্ত ই সব। জুডিসিয়ারিও সংসদ তথা পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন। এমনকি কোন আইন সঠিক না ভুল- এই ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা কোর্টের হাতে নয়, জাতীয় কনগ্রেসের হাতে (NPC). National People’s Congress কে একটি ছাতা হিসেবে দেখা হয় যার অধীনে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ কাজ করে। চায়না জুডিসিয়ারি কে অাধুনিক করার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করছে। প্রযুক্তি ও উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে আইন ও বিচারে কাঙ্খিত পরিবর্তন আনছে। চায়নার বিরুদ্ধে সমালোচনা আছে, কিছু সত্য তবে বেশির ভাগ রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা। চায়না ভাল করে জানে, দ্রুত ও সঠিক বিচার প্রাপ্তি অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম উপাদান, উন্নয়নের দৃশ্যমান মাপকাঠি।
শেষ করছি আবারও কনফুসিয়াস কে স্মরণ করে। তিনি বলেছেন, “The real fault is to have fault and not amend them.”
লেখক– চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মাগুরা।
judgezia@gmail.com