অ্যাডভোকেট মোকাররামুছ সাকলান

রাষ্ট্র ভাষা বাংলা কিন্তু ‘আদালতের ভাষা’ ইংরেজি না বাংলা?

মোকাররামুছ সাকলান:

ভাষাসৈনিক ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট গাজীউল হক লিখিত ‘উচ্চতর আদালতে বাংলা প্রচলন নামক বইতে বলেছেন ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থির, অচঞ্চল কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।“ এরপর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের সংবিধান পেশ করার সময় এই বাংলার ভাষা নিয়ে মুল ঝামেলা তৈরি হয় যার পর ১৯৫২ ভাষা আন্দলোন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পর বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমীর এক অনুষ্ঠানে দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ঘোষনা দেন।

পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের গৃহীত সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে ‘রাষ্ট্রের ভাষা’ হবে বাংলা। সংবিধানের ১৫৩ নং অনুচ্ছেদের উপ- অনুচ্ছেদ ২ তে বলা আছে, ‘বাংলায় এই সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ ও ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকিবে। উভয় পাঠ নির্ভরযোগ্য বলিয়া গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন। এছাড়া ১৫৩(৩) অনুচ্ছেদের ৩ দফায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের ২ দফা অনুযায়ী সার্টিফিকেট যুক্ত কোনো পাঠ এই সংবিধানের বিধানাবলীর চূড়ান্ত প্রমাণ বলিয়া গণ্য হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে। অর্থাৎ আমাদের, ‘রাষ্ট্রের ভাষা’ হলো ‘বাংলা’।

এরপর ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রীম কোর্টের এক উদ্ববোধনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমান বক্তব্য দেন যা পরবর্তিতে বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্ট হয়।

দৈনিক আজাদ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে প্রকাশ করেন “বাংলা প্রবর্তন আইন সংক্রান্ত শব্দাবলীর বঙ্গানুবাদের সুবিধার্থে একটি কমিশন গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতি জনাব এ এম সায়েম যে প্রস্তাব রাখেন তার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, এ পদ্ধতি আদালতের কার্যক্রম বিলম্বিত করবে। তিনি মাননীয় বিচারপতিদের কে রায় বাংলায় প্রদান করার আহ্ববান জানান। তিনি বলেন যে আদালতের কাজে বাংলা প্রবর্তনের সকল প্রচেস্টায় সরকার সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাবে। সুপ্রীম কোর্টের জন্য সরকার শিগগিরই বাংলা টাইপ সংগ্রহের ব্যবস্থা করবে। এছাড়াও বাংলা সাটলিপি পাঠও প্রবর্তন করা হবে।”

১৯৭৫ এর ২৩ অক্টোবর একটি সরকারি আদেশপত্রে বলা হয়, “অতএব পুনরায় এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে যে, সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধা-সরকারি দফতরে বাংলায় নথি ও চিঠিপত্র লেখা হবে। বিদেশের কোনো সরকার বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বাংলার সঙ্গে অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রতিলিপি ব্যবহার চলবে। তবে কোনো বিদেশি সরকার বা সংস্থার সঙ্গে পত্র যোগাযোগ ইংরেজিতে করা যাবে।”

এরপর ১৯৭৯ এর ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি ইংরেজিতে আদেশ জারি হয়। আদেশের কিছু অংশ ছিল এমন “All work and files concerning the cabinet and ministries may be conducted in Bengali from now onwards.”

তারপর বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ এ প্রনয়ন হয়। এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে ৩। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।

(২) ৩(১) উপ-ধারায় উল্লেখিত কোন কর্ম স্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।

(৩) যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।

এছাড়া আমাদের সুপ্রীম কোর্ট উচ্চ আদালতের বিচারিক কার্যক্রম চালানোর সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগের জন্য দুইটি বিধিমালা তৈরি করা আছে।

হাইকোর্ট বিভাগের বিধিমালায় অধ্যায় ৪ বিধি ১ বলা আছে “Applications to the High Court Division shall be in Bangla/English”. আবার আপীল বিভাগের বিধিমালায় আদেশ ৭ বিধি ৩ এ বলা আছে ‘Any document in a language other than Bengali or English shall be accompanied by its translation in either of the two languages in accordance with the Rule’’

অর্থাৎ বিধিমালা অনুযায়ী হাইকোর্টে এবং আপীল বিভাগে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষা ব্যবহারে কোন বাধা নেই।

এদিকে দেওয়ানী কার্যবিধি আইন, ১৯০৮ ধারা ১৩৭ এ বলা আছে- “(1) The language which, on the commencement of this Code, is the language of any Court subordinate to the High Court Division shall continue to be the language of such subordinate Court until the Government otherwise directs.
(2) The Government may declare what shall be the language of any such Court and in what character applications to and proceedings in such Courts shall be written.

(3) Where this Code requires or allows anything other than the recording of evidence to be done in writing in any such Court, such writing may be in English; but if any party or his pleader is unacquainted with English a translation into the language of the Court shall, at his request, be supplied to him; and the Court shall make such order as it thinks fit in respect of the payment of the costs of such translation.”

অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮ এর ধারা ৬, ২৬৫,৩৫৬,৩৫৭, ৩৬৪, ৩৬৭ পড়লে দেখা যায় ফৌজদারি মামলায় চার্জ, কিংবা সাক্ষ্য বা রায় অন্য কোন ভাষা বা ইংরেজিতে হতে পারে।

অর্থাৎ দেওয়ানী ও ফৌজদারি উভয় মামলায় ইংরেজী ভাষা ব্যবহারে কোন বাঁধা নেই। বরং অন্য কোন ভাষার অবর্তমানে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হবে বলা হয়।

এখন তাহলে খুব সহজে প্রশ্ন আসে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ এর প্রবর্তনের পর দেওয়ানী কার্যবিধি আইন ১৯০৮ ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ এর কোন পদ্ধতিতে ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের কি কোন বাধ্যবাধকতা আছে কি না? এক কথায় উত্তর না কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কেন?

এর উত্তর খুজতে গেলে আমাদেরকে ৪৪ ডি এল আর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা ৩৩২ উল্লিখিত হাসমত উল্লাহ বনাম আজমীরি বিবি এর রায় দেখতে হবে।

ঐ মামলায় বাদী নিম্ন আদালতে ইংরেজি তে আরজি বা Plaint জমা দিয়েছিলেন। এটা দেখে বিবাদী পক্ষ আরজি খারিজের দরখাস্ত দেয় এবং দাবী করে যে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ এর ৩ ধারা অনুযায়ী আরজি বাংলায় হবার কারনে তা খারিজ যোগ্য। নিম্ন আদালত আরজি খারিজ না করার কারনে বিবাদী পক্ষ হাইকোর্টে এই সিভিল রিভিশন মামলাটা করেন। সিভিল রিভিশন শুনানি করে হাইকোর্ট আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে ইংরেজীতে আরজি করলে মামলা খারিজ হবে না বলে রায় দেন। এই রায় এখন পর্যন্ত বহাল এবং এই রায়ের ব্যাখ্যার কারনেই আদালতে ইংরেজিতে রায় দেওয়া কিংবা আরজি জবাব জমা দেওয়া অপরাধ নয়।

রায়ের আদালত আইনের বেশ জটিল ব্যাখ্যা দেন। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ এর প্রবর্তনের পর দেওয়ানী কার্যবিধি আইন ১৯০৮ ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ কে তুলনা করে বলেন যে দেওয়ানী কার্যবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইন দুটি বিশেষ আইন (Special Law)। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ একটি সাধারন (General Law)আইন। আদালত আরও বলেন যদিও এই তিনটি আইন একই সমান এবং এদের কর্তৃত্বের একই উৎস অর্থাৎ পার্লামেণ্ট তাই এরা কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়।

আইনের সাধারন নীতি হল বিশেষ আইন ও সাধারন আইনের তুলনাতে বিশেষ আইন বজায় থাকবে।

আদালতের পর্যবেক্ষন গুলি হল

“In course of dealing with this matter we have come across 3(three) terms- “State language,” “official language” and “court language”.

State language means the language to be used in all state activities-executive, legislative, judicial, etc.
Official language means the language to be used for the purpose of the business of the Government.
Court language means the language to be used only for the purpose of the business of the court of the 3 (three) terms the “court language” is the narrowest one.
The term” court language “means the language to be used for the purpose of the business of the court. The Act (Bangla Bhasha Prochalan Aine) has been enacted under Article 3 of the Constitution which provides for making Bengali as State language. The term ‘court language’ being narrower, would exclude the application of the term “state language” for the purpose of the language to be used in the subordinate court. (Para 19)

“In the absence of a non-obstante expression or an overriding provision or a repealing provision in the Act (Bangla Bhasha Prochalan Aine) we are unable to hold that sub-section 1 read with sub-section 2 of section 3 of the Act by implication has repealed or made section 137 of the Code of Civil Procedure nugatory. There is no dispute that before the Act (Bangla Bhasha Prochalan Aine) came into being, pleadings (plaints), applications, etc. written either in Bengali language or English language could legally be filed in the subordinate civil courts. There is no dispute that under section 137 of the Code of Civil Procedure the Government has the power to declare what shall be the language/languages of the subordinate civil courts. There is no dispute that the Government has not made any declaration under section 137(2) of the Code of Civil Procedure prohibiting the use or discontinuing the use of English language in the subordinate civil courts. (Para 20)

আমি মনে করি আমাদের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগের বিধিমালাতে ইংরেজীতে রায় দিতে কোন বাঁধা নাই, তারপর ৪৪ ডি এল আর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা ৩৩২ মামলার রায় অনুযায়ী যেহেতু আমাদের আদালত সমুহে এখনো বাংলায় রায় দিতে কোন বাধ্যবাধকতা নেই তাই ইংরেজী তে রায় দিলে তা অপরাধের মধ্যে পড়বে না। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন মাননীয় বিচারপতি বাংলায় রায় লিখছেন ।

বাংলায় লিখা ব্যাপারটা যদি আমাদের সকল আইনজীবী সহ সকল মাননীয় বিচারক ও বিচারপতি মহোদয় বৃন্দের দৈনন্দিন কাজে পরিনত হয় তবে দেশের সকল আদালতে বাংলা এবং শুধু বাংলা ভাষার শব্দের ব্যবহারই হবে। এছাড়া আমাদের দেওয়ানী কার্যবিধি আইন ১৯০৮ ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ এ বাংলা ভাষা বাধ্যতামুলক ব্যবহারের জন্য পরিবর্তন আনতে হবে।

তথ্যসুত্র-
১) ৪৪ ডি এল আর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা ৩৩২।
২) Criminal Revision (Suo Motu) No. 246 of 2018; State vs M Wahidul Haque and ni-hprc; Judgement Date: December 06, 2018. জনাব বিচারপতি আশরাফুল কামাল, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট মহদোয়ের রায়ের থেকে সংকলিত।
৩) “উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার : সমস্যা ও সমাধান” লেখকঃ মাননীয় বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান। হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। প্রবন্ধটি দুই পর্বে বিগত ০৯ এবং ১২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।