ড. মো. শহীদুল ইসলাম:
কোভিড ১৯ তথা করোনাভারাস এখন বিশ্ব মহামারী। খালি চোখে এ ভাইরাস দৃশ্যমান না হলেও সারা বিশ্ব ব্যাপী চলছে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ । এর করাল হিংস্র থাবা চলছে বাংলাদেশেও। এমন অবস্হায় দেশের উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতসমূহে সীমিত আকারে কার্যক্রম চালু রাখার যে ঘোষণা করা হয়েছিল ও পরবতীতে তা স্হগিত করা নিয়ে আইনজীবীরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় সমগ্র বিশ্ব। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশেও চলছে এর সংক্রমনের ভয়াল চিত্র। বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ইতোমধ্যে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছেন যা ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশের জনগনকে এ মহামারী হতে সুরক্ষা প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছেন। দিচ্ছেন জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ও প্রসাশনের বিভিন্ন লেভেলে কার্যকর নির্দেশনা। ত্রান সাহায্যে এগিয়ে অসছেন ব্যক্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সেচ্ছাসেবী সংগঠন। ছাত্র ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলো ক্ষুধার্তদের মাঝে খাবার পৌছে দেয়াসহ অসহায় কৃষকদের ক্ষেতের ধানও কেটে দিচ্ছেন।
সরকারের প্রসাশন, গর্বিত সেনাবাহিনী এবং আইন শৃংখলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা এ ভাইরাস রোধ- প্রশমনে রাত দিন কাজ করে যাচ্ছে। সংক্রমনের ভয় উপেক্ষা করে সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স সহ সেবা কর্মীরা। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন চিকিৎসক, সরকারী কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
এ ভাইরাসের কার্যকর ভেকসিন এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। ভাইরাসটির এমন প্রকৃতির যে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেই এক মানব দেহ থেকে অন্য মানব দেহে তা দ্রুত ছডায়। এমন পরিস্হিতিতে প্রায় সারাদেশেই চলছে লকডাউন। জোর দেওয়া হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব (social or physical distance) বজায় রেখে সুরক্ষা নিশ্চিত করার। জনগনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ঘরে থাকতে। এ বিষয় গুলো মানা না হলে এ ভাইরাস দেশে ভয়ংকর পরিস্হিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশেজ্ঞরা হুসিয়রি উচ্চারণ করেছেন।
এ ভাইরাসের সংক্রমন রোধের জন্য বিশ্বের প্রার্থনালয় গুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে মুসলমানদের পবিত্র ঘর কাবা-মসজিদে নববী। অন্যান্য দেশের মতো নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাদের দেশের মসজিদসহ বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়ে উপস্হিতি নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত রাখতে। ইতোমধ্যেই মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিমসহ অন্যান্য ধর্মের উপসনাকারিরা। এ প্রসংগে উল্লেথ্য, সম্প্রতি খবরে প্রকাশ পুরাণো ঢাকার ইসকন মন্দিরে অবস্থানকারী ৩০ জন ধর্মজাযকই করোনা আক্রান্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা সিটি ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহকে ঝুকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে। আক্রান্তের সংখ্যা দিনদিন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। দেশে চলছে ঐ মরণ ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিউশন। আজ (২৯ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিং এ বলা হয়েছে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪১ জন, মোট দাঁড়িয়েছে ৭১০৩ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ১৫০ জন। নতুন মৃত্যুর সংখা ৮ জন, মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৩ জন।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষ সাধারণত আত্বীয় স্বজনদের বাসায় যায় না এবং তাদের আত্বীয় স্বজনদেরকও বাসায় আসতে নিরুৎসাহিত করে। দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কোন লোক গেলেই ভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে তাকে কোয়ায়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এমন ভয়ংকর পরিস্হিতিতে অমানবিক-নিষ্ঠুর স্বজনরা ভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে বৃদ্ধদেরকে নিদারুন অসহায় অবস্থায় জংগল, রাস্তায় ফেলে রেখে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছেই। ভাইরাসে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির স্বজনরা পর্যন্ত তার শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করতে অনিহা প্রকাশ করছে।
ক্ষুধার্ত মানুষেরা মানবিক সাহায্য ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে ত্রাণ তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
বিজ্ঞ বিচারক ও আইনজীবীরা স্বচেতন থাকায় ভাইরাসে আক্রান্তের মিছিলে তাদের সংখ্যা কম। আদালত বন্ধ থাকার এমন পরিস্থিতিতে অনেক আইনজীবীরা আর্থিক কষ্টে রয়েছেন। বিশেষ করে জুনিয়র আইনজীবীরাই বেশী ভুক্তভোগী। এমন পরিস্থিতিতে সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞ রেজিস্ট্রার জেনারেল ২৩ এপ্রিল এক স্মারকের মাধ্যমে দেশের জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহে জরুরী বিষয় শুনানির জন্য সীমিত আকারে আদালতের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আরেক ঘোষণায় সুপ্রীম কোর্টের আপাীল বিভাগের একটি Judge in Chamber Court এবং হাইকোর্ট বিভাগের আরেকটি Bench সীমিত আকারে বিচার কাজ পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছিল।
ঐ ঘোষণার প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইনজীবীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঐ প্রতিক্রিয়ায় অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী বর্তমান ভাইরাস পরিস্হিতিতে মাননীয় বিচারপতিদের এবং আইনজীবীদের সুরক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। একজন আইনজীবী যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছিলেন, জীবন আগে না মৌলিক অধিকার আগে।আরেক জন আইনজীবী বলেছিলেন, এ ঘোষণার মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্ট প্রাংগনে করোনাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এর বিপক্ষেও কিছু আইনজীবী কোর্ট বন্ধ থাকায় আইনজীবীদের আর্থিক কষ্টের কথা বলেন। আবার কিছু আইনজীবী প্রশ্ন তুলেছিলেন উন্নত বিশ্বের মতো বর্তমান প্রযুক্তি ব্যাবহার করে (ই-ফাইলের মতো) আদালতের কার্যক্রম চালাতে হলে আদালতের রুলস্ সংশোধন করতে হবে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
তাছাডা উচ্চ আদালতে দাখিলকৃত প্রত্যেকটি আবেদনে ক্ষেত্র মতে বিচারপ্রার্থী বা তদবিরকারের মাধ্যমে কোর্টে এফিডেভিড কমিশনারের নিকট সশরীরে হাজির হয়ে এফিডেভিট করতে হয়। সুপ্রীম কোর্টে সারা বাংলাদেশের একমাত্র উচ্চ আদালত। বর্তমান লকডাউন পরিস্হিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিচারপ্রার্থী মানুষ কীভাবে উচ্চ আদালতে আসতেন। চলাচলের জন্য কিছু প্রতিষ্ঠিত – সচ্ছল আইনজীবীর নিজস্ব বাহন থাকলেও অধিকাংশ আইনজীবীর তা নাই। এ ক্ষেত্রে জুনিয়র অধিকাংশ আইনজীবীদের সমস্যা আরো প্রকট। চলাচলে আরোপিত বাধা-নিষেধ পেরিয়ে তারা লকডাউনের ভেতর কিভাবে কোর্টে পৌঁছতেন। সীমিত কার্যক্রম পরিচালনার সময় মাননীয় আদালতের পক্ষে কয়টা মামলার শুনানীর একোমোডেশন দেওয়া সম্ভব হতো। এতে আইনজীবীদের প্রতি তাদের মোয়াক্কেলের চাপ আরো বাড়ত । আদালতের সীমিত কার্যক্রমে আইনজীবীদের পক্ষে তাদের মোয়াক্কেলের মামলায় কাংক্ষিত ফল দেওয়া প্রায়ই সম্ভব হয়ে উঠতে না। যার ফলশ্রুতিতে বিব্রতকর পরিস্হিতির সৃষ্টি হতো।
কিছু আইনজীবী প্রশ্ন রাখেছিলেন আদালতের ঐ সীমিত কার্যক্রমে বিচার প্রার্থীদের অনেকের মামলা শুনানী করা সম্ভব হবে না তাই “ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী” সংবিধানের এই মৌলিক অধিকার থেকে তারা deprive হতেন।
কিছু আইনজীবী যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছিলেন বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার কথা। কিন্ত ই-ফাইলিংসহ আদালতের সকল কার্যক্রম ডিজিটাল প্রসিডিরের নিয়ে আনা সময়ের ব্যাপার। এ বিষয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও ই -সিস্টেম ও প্রসিডিউর ওয়াকিবহাল হতে প্রশিক্ষনের প্রয়োজন। যা বাস্তবায়ন করা এ মুহূর্তে সম্ভব হবে না।
সে ক্ষেত্রে উদ্ভুত করোনা ভাইরাস পরিস্হিতিতে মাননীয় বিচারপতিদের, বিজ্ঞ বিচারকদের, বিজ্ঞ আইনজীবীদের এবং তাদের সহকারিদের ও বিচার প্রার্থী মানুষদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সুরক্ষা প্রদানের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঐ আইনজীবীগণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনাটি পূন:বিবেচনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছিলেন।
গত (২৬ এপ্রিল) বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদের নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক ফুল কোর্ট মিটিং করেন। ঐ মিটিং এর বরাত দিয়ে টিভি মিডিয়া, অন লাইন পত্রিকা এবং বিভিন্ন প্রত্রিকায় এর সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছে। তাতে মাননীয় প্রধান বিচারপতির বরাত দিয়ে বলা হয় সুপ্রীম কোর্টের কার্যক্রম আগামী ৫ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
সুপ্রীম কোর্টের আরেকটি সূত্রে বলা হয় যে, বিচারপতিদের ঐ ফুল কোর্ট মিটিংএ জরুরী মামলার ভার্চুয়াল হিয়ারিং এবং অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানির প্রয়োজনীয় রুলস্ সংশোধনের ক্ষেত্রে মহামান্য রাষ্টপতির অনুমোদন প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করা হয়।
ঐ ফুল কোর্ট মিটিং এর সিদ্ধান্তনানুসারে সামগ্রিক পরিস্হিতি বিবেচনায় ৫ মে পর্যন্ত সুপ্রীম কোর্টের সাধারণ ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে।
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের ঐ সময়োচিত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সাধারণ আইনজীবীগণ বলেন, বর্তমান সিদ্ধান্ত না এলে, ঐ পরিস্হিতিতে আদালত সংশ্লিষ্ট যদি কেউ ঐ মরণ ভাইরাসে আক্রান্ত হতো, মানুষ তখন আদালত খোলা রাখাটাকে দায়ী করতো, এটাই স্বাভাবিক। যার সহিত উচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি সম্পৃক্ত ছিল। তাই বিষয়টি বিরাজমান পরিস্হিতির সার্বিক পর্যালোচনায় মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ এবং মাননীয় প্রধান বিচারপতির সময়েচিত ও সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে মাননীয় বিচারকবৃন্দ, বিজ্ঞ আইনজীবী, বিচার প্রার্থী মানুষ ও আদালত সংশ্লিষ্টদের বর্তমান ভাইরাস pandemic পরিস্থিতে আক্রান্ত হওয়া থেকে অনেকটা সুরক্ষা দিবে। জীবন বাঁচলে মামলাও নিস্পত্তি হবে।
আশা করি, আঁধার পেরিয়ে আলো আসবেই। কেটে যাবে এ করোনা মহমারী অচিরেই। সুরক্ষিত থেকে বিচার কাজ পরিচালনা করবেন মাননীয় বিচারকগণ। আইনজীবীগণের পদভারে আবার ভরে উঠবে আদালত প্রাঙ্গণ। পূর্বের মতো দেখা যাবে বিচার প্রার্থীদের সরব উপস্হিতি। স্বাভাবিক হবে দেশ। অব্যহত থাকবে উন্নয়নের ধারা। সুখি ও সমৃদ্ধশালী হবে এ সোনার বাংলাদেশ।
লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, সাবেক সহ-সম্পাদক, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।