মীর আব্দুল হালিম:
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে সারা বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ আইন ও বিচার ব্যবস্থায় সুস্পষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারকে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। একদিকে আদালত বন্ধ অন্যদিকে মানুষের মৌলিক ও সাধারণ অধিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অনেকেই এটাকে সাংবিধানিক ও আইনের সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেকেই জরুরি অবস্থা ঘোষণার পক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ বিদ্যমান আইন সংশোধন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আইনের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যের উদাহরণ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি। সম্প্রতি ব্রিটেনে করোনা ভাইরাস আইন ২০২০ পাশ করেছে। এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং অন্যদিকে আমরা তো যুগ যুগ ধরেই ব্রিটিশ আইনের অনুসারী।
যুক্তরাজ্য করোনা ভাইরাস আইন ২০২০
২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে যুক্তরাজ্যের আইনসভা ‘করোনা ভাইরাস আইন ২০২০‘ পাশ করেছে এবং তা একই দিনে রাজকীয় সম্মতির মাধ্যমে আইন হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে সৃষ্ট আইনি জটিলতা নিরসনে যুক্তরাজ্যই প্রথম আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজেছে। আইনটি সরকারকে বিশেষ নির্বাহি ক্ষমতা প্রদান করেছে যাতে করে সে মহামারীর কারণে সৃষ্ট আইনি জটিলতায় মানবাধিকার রক্ষা করে নানা রকম নিয়ন্ত্রণ মূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
করোনা ভাইরাস আইনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সমূহ
এই আইনটি জনগণের সমাবেশকে সীমাবদ্ধ অথবা স্থগিত করার, করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত ব্যক্তিদের আটক রাখার এবং রোগের সংক্রমণ সীমাবদ্ধ করতে জনসাধারণের ওপর ভার কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের দৈনন্দিন কার্যক্রম স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বা শিথিল করার জন্য সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা চর্চার বৈধতা প্রদান করে। ৩৫৯ পৃষ্ঠার এ আইনে ১০২ টি ধারা ২৯ টি সিডিউল রয়েছে যার মধ্যে ৮৯ ধারাটি সূর্যাস্ত নীতি (Sunset Rule) প্রদান করে। এ নীতি অনুসারে আগামী দুই বছর পর সূর্যাস্তের সাথে সাথে আন্টি রহিত হয়ে যাবে তবে সংসদ চাইলে বিশেষ অবস্থায় ৬ মাস কম বা বেশি করতে পারে। আগ্রহী ব্যক্তিগণ এই লিংকে আইনটির কপি দেখতে পারেন।
এই আইনটি জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা, সমাজসেবা,, গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধকরন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় দপ্তর, স্বাস্থ্য সেবায় মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং অবসর প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা ভুক্তকরণ, দাফন-কাফন এবং আদালত সহ প্রয়োজনীয় সরকারি সেবাগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ওপর ভার কমিয়ে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রণয়ন এবং পাশাপাশি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মালিক ও কর্মচারীদের সহায়তার জন্য সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এই আইনে মহামারী কালীন অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবেলার ব্যবস্থাও দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদের কাজ বন্ধ করা (বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভাড়াটিয়াদেরকে তিন মাসের জন্য নোটিশ প্রদান থেকে বিরত থাকা), জরুরী স্বেচ্ছাসেবীদের বেকার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা এবং অতিরিক্ত কর্তব্য পালনের কারণে স্বাস্থ্য সেবাকর্মীদের জন্য বিশেষ বীমা কভারেজ সরবরাহ করা।
করোনা ভাইরাস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীদেরকে অসুস্থতা ছুটির আওতায় নিয়োগদাতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে এবং সুপারমার্কেট চেইন সমূহের ঘটনা, খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি কিংবা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়ে সরকারকে নিয়মিত রিপোর্ট করবে। কর্মচারীরা তিন দিনের নোটিশ দিয়ে জাতীয় স্বেচ্ছাসেবায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে যার কারণে তার বর্তমান চাকরি ব্যাহত হবেনা।
করোনা ভাইরাস আইনে ই–জুডিশিয়ারি চালুকরণ
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় উক্ত আইনেরই -জুডিশিয়ারি বা ডিজিটাল ফাইলিং ও শুনানী চালু করার বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে। আইনটি বিদ্যমান কার্যপদ্ধতি সংশোধন করে টেলিফোন বা ভিডিও কনফারেন্সিং সুবিধা গুলি ব্যবহার করে শুনানিতে অংশ নেওয়া সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষের শারীরিক ভাবে আদালতে উপস্থিতির প্রয়োজন ছাড়াই অডিও/ভিডিও শুনানি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। যুক্তরাজ্য আদালত চলমান রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই এ ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে।
বাংলাদেশে সাংবিধানিক অথবা হয়নি সংকট
বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সাধারণ ছুটি ও সীমিত আকারে লক ডাউন ঘোষণা করেছে যা আগামী ৫ মে ২০২০ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং সমস্ত গণপরিবহন স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৮ এর অধীনে সারাদেশকে করোনা ভাইরাস এর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে, এমনকি জনগণের চলাচল কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বিশেষ করে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত যেকোনো ধরনের চলাচল নিষিদ্ধ। আইন অমান্য করলে মোবাইল কোর্ট এর আওতায় জেল ও জরিমানা গুণতে হবে এবং বাস্তবে গুনতে হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট সহ নিম্ন আদালত সমূহ বন্ধ থাকায় বিচার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জামিন প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে এক জটিলতা।
এই জটিলতাকে অনেকেই সাংবিধানিক সঙ্কট হিসেবে দেখছেন এবং অনেকেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা বা সংবিধান স্থগিত করার কথাও বলেছেন। আবার অনেকে “দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২“ সংশোধনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও বৈধতা নেওয়ার কথা বলেছেন। আমি মনে করি এটা সাংবিধানিক সংকট নয়। এই সংকট মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং সাধারণ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবেলা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সাধারণ ব্যবস্থাপনায় যেমন কৃতিত্ব দেখাচ্ছে তেমনি একটি নতুন আইন প্রণয়ন করলে এ সংকট বিচার বিভাগে কেটে যাবে এবং আদালত ব্যবস্থাপনায় কোন সংকট থাকবে না। আমাদের সরকারে বিজ্ঞ আইনজ্ঞরা রয়েছেন, রয়েছেন আইনপ্রণেতারাও, তারা যুক্তরাজ্য সরকারের কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত হয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারে।
বাংলাদেশে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করতে আইন সংশোধন আবশ্যক
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সহ দেশব্যাপী অবস্থিত নিম্ন আদালত সমূহে ভার্চুয়াল কোর্ট, ই-কোর্ট, অনলাইন শুনানি, অনলাইন ফাইলিং, পক্ষ সমূহের আদালতে অনুপস্থিতির গ্রহণ যোগ্যতা, ইমেইল কমিউনিকেশনকে পোস্টাল নীতি হিসেবে গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয় সহ ডিজিটাল কোর্ট চালু করতে হলে বিদ্যমান কার্যপদ্ধতি ও সাক্ষ্য আইনের সংশ্লিষ্ট কিছু ধারা সংশোধন করতে হবে। এসব আইন ও বিধি সংশোধন ছাড়া ডিজিটাল কোর্ট চালু করা হলে তা পদ্ধতিগত আইনের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন থেকেই যাবে। পাশাপাশি নবীন ও প্রবীণ আইনজীবী, বিচারক এবং আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো বিবেচনার বিষয়। করোনার সময়ে যেখানে চলাচল সীমাবদ্ধ সেখানে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় এই অচলাবস্থা একটি আইনি শংকট যাকে অনেকেই সাংবিধানিক সংকটের সাথে তুলনা করছেন, অনেকেই ডিজিটাল কোর্ট চালুর মাধ্যমে মানুষের বিচারের অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে মতামত দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্যের আইন থেকে দিক নির্দেশনা নিতে পারে এবং বাংলাদেশের জন্য উপযোগী করে প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত করে আইন প্রণয়ন করতে পারে। সংসদের অধিবেশন না বসতে পারলেও সংবিধানে প্রদত্ত বিকল্প ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে এ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারকে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি, গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করন, সরকারি ও বেসরকারি অফিস এবং শিল্প-কারখানা ইত্যাদি বন্ধের জন্য ব্যাপক ক্ষমতা সম্পন্ন আইনি ভিত্তি দরকার। মহামারী নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্বাহী ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির দ্বৈত চরিত্রের কথা বিবেচনা করে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা রাখার পক্ষে ও বিশেষজ্ঞরা মত প্রদান করেছেন।
এসব অবস্থা মোকাবেলায় একটি নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন সহ অন্যান্য বিষয়ে সামগ্রিক দিকনির্দেশনা থাকতে পারে যা জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাক্ষরিত চুক্তিসমূহ ফোর্স মেজার বা দৈবশক্তির কারণে চুক্তি পালন করা অসম্ভব হতে পারে এবং সে সবক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে নতুবা অদূর ভবিষ্যতে চুক্তিভঙ্গ সংক্রান্ত হাজারো মামলা আদালতে গড়াবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনী বিশ্লেষন ও শিক্ষামূলক এবং লেখক এর ব্যক্তিগত অভিমত।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
ইমেইল: bnm.mir@gmail.com