বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি ও ক্রমকাল অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যয়। প্রাচীন যুগ (৬৫০ – ১২০০) খ্রিঃ, মধ্য যুগ (১২০০ – ১৮০০) খ্রিঃ ও আধুনিক যুগ ১৮০০ খ্রিঃ থেকে বর্তমান অবধি।
আধুনিক যুগের প্রারম্ভ থেকেই নানা দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের নতুন নতুন সৃষ্টি, বিকাশ, সমৃদ্ধি ও গতিশীল হতে থাকে। বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্য ও ভাষা সমাদৃত ও গুরুত্ব পেতে থাকে।
এই যুগেই বাংলা সাহিত্যের নব জাগরণ সৃষ্টি হয়। প্রাচীন যুগ ছিল পদ্য নির্ভর। ধর্ম, হৃদয়াবেগ ও রাজ কাহিনী ভিত্তিক।
কিন্তু আধুনিক উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের বিশেষত্ব হচ্ছে, শক্তিশালী গদ্য সাহিত্য সৃষ্টি, জ্ঞান বিজ্ঞানের নানাবিধ বিষয় ভিত্তিক সাহিত্য সৃষ্টি, মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, দেশপ্রেম বিষয়ক সাহিত্য কর্ম, পদ্য থেকে গদ্য সাহিত্যের উত্তরণ, চলিত ভাষা সাহিত্যের মর্যাদা লাভ ও বৈচিত্রের উদ্ভব।
এই নবজাগরণ বা রেনেসাঁর যুগে অখণ্ড বাংলায় যেসব সাহিত্যগুরু জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ও এই নব জাগরণ এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিলেন, কোন কোন ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করেছিলেন তাঁদের অনেকেই পেশায় ছিলেন আইনজীবী, বিচারক বা আইনের ছাত্র।
কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর আইন বিষয়ে অধ্যায়ন করেছিলেন। ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় আর এক নক্ষত্রের নাম রজনীকান্ত সেন। তিনি প্রখ্যাত কবি, গতিকার ও সুরকার হিসাবে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশ প্রেমই তাঁর সৃষ্টির প্রধান বৈ শিষ্ট। ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে ১৮৬৫ খ্রিঃ ২৬ জুলাই তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন। রজনীকান্ত সেন বোয়ালিয়া স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৮৮৩ সনে তিনি কুচবিহার জেন কিন্স স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৮৯১ সনে তিনি বি এল ডিগ্রি অর্জন করেন। রজনী কান্তের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজশাহী আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ভাইয়ের হাত ধরেই ১৮৯১ খ্রিঃ সনে তিনি রাজশাহীতে আইন পেশায় নিযুক্ত হন।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের এক অতি পরিচিত নাম অতুল প্রসাদ সেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার ও গায়ক। বাংলাভাষীদের নিকট অতুল প্রসাদ সেন প্রধানত একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তাঁর গানগুলি মূলত স্বদেশি সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান; এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে তাঁর ব্যক্তি জীবনের বেদনা সকল ধরনের গানেই কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তাঁর অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণ-রস প্রধান। তাঁর রচিত মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! গানটি বাংলা ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অণুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রবীন্দ্র প্রতিভার প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যাঁরা বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, অতুল প্রসাদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। অতুল প্রসাদের অনেক গানে সাঙ্গীতিক মৌলিকত্ব পরিলক্ষিত হয়; আর সে কারণেই তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতে এক স্বতন্ত্র আসন লাভ করেছেন। তাঁর গানগুলি অতুল প্রসাদের গান নামে বিশেষ ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
অতুল প্রসাদ সেনের পৈতৃক ভিটা বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ায়। তিনি ঢাকায় তাঁর মাতুলালয়ে ১৮৭১ খ্রিঃ ২০ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন। অতুল প্রসাদ লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৮৯৪ সনে তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসে রংপুর ও কলিকাতায় আইনজীবী হিসাবে অনুশীলন করতে থাকেন। পরে তিনি লাখনউ চলে যান। লাখনউতে তিনি অবোধ বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও পরবর্তীতে অবোধ বার কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দ্বিজেন্দ্র লাল রায় বা ডি এল রায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙ্গালি কবি, নাট্যকার ও সঙ্গীত স্রষ্টা। তাঁর গান দ্বিজেন্দ্র গীতি নামে পরিচিত। ১৮৮৬ সনের তাঁর প্রথম ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্য ও বাংলাদেশ প্রেমের গান “ধন ধান্য পুস্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” এই চিরঞ্জীব সঙ্গীতের স্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৯ জুলাই ১৮৬৩ খ্রিঃ অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৮৭৮ খ্রিঃ কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এফ. এ. পাস করেন কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাস করেন।
পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে সরকারি চাকরি হতে অবসর নেন।
বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে – ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তিনি বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পদে পদন্নতি পেয়েছিলেন।
তবে সরকারি কর্মকর্তা বা বিচারক হিসাবে নয়, বাংলা গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসের জন্য বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় ১৮৩৮ খ্রিঃ ২৬ জুন তারিখে, বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে।
নবীন চন্দ্র সেন চট্টগ্রামের রাউজানে ১৮৪৭ খ্রিঃ জন্ম গ্রহণ করেন। নবীন চন্দ্র সেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। মাত্র একুশ বৎসর বয়সে তিনি কর্ম জিবনে প্রতিস্থিত হন। তিনি ১৮৬৯ সনে যশোরের ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে যোগ দেন। চাকরি জীবনে তিনি অনেক সফলতা দেখাতে পেরেছিলেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন একজন ব্যারিস্টার। বাংলা সাহিত্যে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
জীবনান্দ দাস ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ দের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনা ছিল মৌলিক ও অনুসন্ধানী। তিনি ১৮৯৯ সনের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির, বরিশাল জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ বিক্রমপুরের অধিবাসী ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজিতে এম এ করার পর আইন বিষয়ে অধ্যায়ন শুরু করেন, তবে সম্পন্ন করতে পারেননি।
হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে স্বদেশ প্রেমের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি কলিকাতা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন। পরে তিনি মুন্সিফ হিসাবে চাকরিতে যান।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯২৮ সনের ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ১৯৬৪ সনে তিনি আইন পেশায় যোগদান করেন। ১৯৭২ সনে তিনি হাইকোর্ট বারের সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৭২ সনে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৮৫ সনে তিনে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন।
একজন রবীন্দ্র গবেষক, ভাষা সৈনিক, অভিধান প্রনেতা, ও লেখক হিসাবে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ খ্রিঃ সন পর্যন্ত সক্রিয় ভাবে ভাষা আন্দলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৪ খ্রিঃ সনে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও ২০০৭ সনে একুশে পদক প্রাপ্ত হন। ২০১৪ খ্রিঃ সনের ১১ জানুয়ারি তিনি মৃত্যু বরন করেন।
গ্রন্থনা ও সম্পাদনা- কাজী হেলাল উদ্দিন, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট