শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ:
দেশে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। খুব সীমিত পরীক্ষায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার এবং প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে মৃতের সংখ্যা দেড়শ অতিক্রম করেছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যেসব ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর উপর ভরসা করে জাতি এই মহাদুর্যোগ অতিক্রমের প্রত্যাশা করছে, সেসব ডাক্তার ও নার্সের অনেকে এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশন ও চিকিৎসাধীনে যেতে বাধ্য হয়েছে। ডাক্তার ও নার্সসহ ইতোমধ্যে কয়েকশ স্বাস্থ্যকর্মীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে তাদের সুরক্ষা সামগ্রীর মানহীনতা এবং মাননিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ও ব্যর্থতাকেই দায়ী করা হচ্ছে। করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুর হার শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি না হলেও ইতোমধ্যে একজন সুখ্যাত ডাক্তার সিলেটে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। ডাক্তার মঈনের অসুস্থ হয়ে পড়া এবং ইন্তেকালের ধারাবাহিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করলে করোনা চিকিৎসা তো বটেই, আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়। যেখানে নিবেদিতপ্রাণ প্রতিভাবান একজন ডাক্তারকেই হাসপাতালে অবহেলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, সেখানে সাধারণ রোগীদের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। দেশে করোনা রোগী ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আগামীদিনগুলোতে এ সংখ্যা হাজারে হাজারে উন্নীত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যসেবার মান ও সমন্বয়হীনতা মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা ও প্যানিক সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণ রোগীদের হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চিকিৎসা না পাওয়া এবং করোনা রোগীদের উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়ার যে সব খবর পাওয়া যাচ্ছে তা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কলঙ্কজনক অশনি সংকেত।
সংক্রমণ ক্রমে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক সতর্কতা এবং সরকারের জাতীয় উদ্যোগের আওতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা রোগীদের জন্য আলাদা বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও সেসব হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা এবং ডাক্তার-নার্সদের অনুপস্থিতি ও রোগীর চরম অবহেলার শিকার হওয়ার ঘটনাবলী দেখে সন্দেহভাজন রোগীরা নিজেদের পরীক্ষা এবং চিকিৎসার আওতায় যেতে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন। এভাবেই অসংখ্য রোগী করোনার উপসর্গ নিয়ে নিজ বাড়িতে অথবা মুমূর্র্ষু অবস্থায় হাসপাতালে এসে মৃত্যুবরণ করছে। সন্দেহভাজন রোগীদের বিলম্বিত পরীক্ষা এবং পরীক্ষার ফলাফল পেতে সময়ক্ষেপণের কারণে আরো অসংখ্য মানুষ সে সব রোগীদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হলেও তারা তা জানতে বা বুঝতেও পারছে না।
এদিকে, করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বঅর্থনীতি লন্ডভন্ড দশায় উপনীত হতে শুরু করেছে। একটি বৈশ্বিক তান্ডবের শিকার হয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে বিশ্ব অর্থনীতি। শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের বিশাল অর্থনৈতিক সামর্থ্য, ট্রিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ফান্ড ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে ব্যবহার করে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার আভাস দিচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দেশগুলোর অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং তৈরী পোশাক রফতানির উপর ভর করে প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বিগত দশকের অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। প্রায় ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। এমনই সন্ধিক্ষণে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব ও হিমশীতল মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে এলো করোনাভাইরাস মহামারী। প্রায় একমাস ধরে দেশের সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও উৎপাদন ব্যবস্থা স্তব্ধ হয়ে আছে। প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের প্রধান রফতানিমুখী খাত এবং জাতীয় রাজস্ব মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে।
বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্র ও অঞ্চল করোনাভাইরাস মহামারীর শিকার। আইএমএফ বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। জীবন বাঁচাতে ঘরে বসে থাকলে সংকট আরো বাড়বে। বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতির বাইরে নয়। আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে যা কিছুই ঘটুক, বাংলাদেশ তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার খুব সহসা আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একইভাবে আমাদের প্রধান বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাজার সউদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক বাস্তবতা আগে থেকেই সংকটাপন্ন। সেই সাথে ইউরোপ আমেরিকা থেকেও হাজার হাজার বাংলাদেশি নাগরিক প্রতিমাসে শত শত মিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছে। করোনামহামারীতে সেসব দেশে কোটি কোটি মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেই সাথে বিভিন্ন দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর কথাও শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখী।
করোনাভাইরাসের লকডাউন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে একাধিকবার স্থানীয় প্রশাসনের সাথে টেলিকনফারেন্স করেছেন। দেশে বিদেশে থাকা অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়েও অনুরূপ টেলিকনফারেন্স করা যেতে পারে। তাদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক বেইল-আউট ও প্রণোদনার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
উন্নয়ন কর্মকান্ডের বাজেট সঙ্কুচিত করে হাজার হাজার কোটি টাকার যোগান দেয়া হচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবেলা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খাতে। লকডাউন প্রত্যাহার করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করতে হলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ অনুসারে প্রথমেই দ্রুততম সময়ে লাখ লাখ মানুষকে করোনাভাইরাস টেস্টের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আক্রান্ত রোগীদের সঠিক কোয়ারেন্টাইন ও উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নতুন সংক্রমণ রোধের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় চলমান বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডাক্তার, নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি রোগী ও তাদের আত্মীয় পরিজনদেরও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। করোনা রোগীরা সম্ভাব্য উপসর্গ ও তথ্য গোপন করলে তা সবার জন্যই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে সব ধরনের হাসপাতালেই ডাক্তার ও নার্সদের জন্য করোনাভাইরাস নিরোধী পিপিই সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস মহামারীর বিপদ উত্তরণে এই চ্যালেঞ্জেও আমাদের সফল হওয়ার বিকল্প নেই।
করোনার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারাদেশে জরুরি ছুটিসহ লকডাউনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। তবে, দেশের অনেক মানুষ যেন উল্টো স্রোতে ভাসতে বেশি পছন্দ করেন, দুয়েকদিন ঘরে থাকলেও কোনো না কোনো উসিলায় বের হয়ে আসছেন। সংক্রামক মহামারীর ইতিহাস বলে, দূরত্ব বজায় রেখেই শুধুমাত্র দ্রুতগতিতে সংক্রমণ রোধ করা যায়। সে হিসেবে আমাদের এখনও সময় আছে বলে আমরা মনে করি। হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনের পাশাপাশি মনকে লাগাম দিয়ে আরেকটু সময় সবাইকে ঘরে থাকার কষ্ট করলেই মিলতে পারে করোনাভাইরাসের এই প্রকোপ থেকে, বন্ধ হতে পারে মৃত্যুর মিছিল।
আমরা এখন একটি জাতীয় দুর্যোগ অতিক্রম করছি। সম্মিলিতভাবেই আমাদের এ সংকট মোকাবেলা করতে হবে। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা যেমন দিনরাত পরিশ্রম করছেন, তেমনি আমাদেরও তাঁদের প্রতি কিছু দায়িত্ব আছে। অসুস্থ হলে আমাদের প্রথমেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁদের কাছে কোনো তথ্য গোপন করা যাবে না। মনে রাখা দরকার, একজনের তথ্য গোপনের কারণে আরো অনেকের বিপদে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়।
লেখক : অ্যাডভোকেট , বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও প্রেসিডেন্ট, সাউথ এশিয়ান ল’ইয়ার্স ফোরাম (সালফ্)।