মীর আব্দুল হালিম:
আপনি কি কারো সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ? বাড়ি ভাড়া, দোকান ভাড়া, অফিস ভাড়া, শিল্প কারখানা ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, চুক্তিভিত্তিক চাকুরি, নির্মাণ চুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভিশন চুক্তি, সাব কন্ট্রাক্ট, সরবরাহ চুক্তি, সেবা চুক্তি, বায়না চুক্তি, সম্পত্তি হস্তান্তর চুক্তি, কিংবা অন্য যেকোন ধরনের চুক্তি? করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে আপনি কি চুক্তি পালন করতে অক্ষম হচ্ছেন কিংবা চুক্তি পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে? বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং বিচারিক নজিরের আলোকে চুক্তি পালনে অক্ষমতা সম্পর্কিত সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করা হল।
করোনা ভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশজুড়ে ঘোষিত লকডাউন অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং সারাদেশে জীবন ও জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষত ব্যবসায়ের চালিকাশক্তি চুক্তি সমূহের উপর। আমাদের দেশে মৌখিক এবং লিখিত দুই ধরনের চুক্তি প্রচলিত। সংকটের কারণে এই চুক্তি সমূহ পালন করা সম্ভব হচ্ছে না বা চুক্তিকারী পক্ষসমূহ অক্ষম হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভাড়াটিয়া এবং কিছু ভাড়াটিয়া সমিতি তাদের মালিকদের কে ভাড়া দিতে অক্ষম হয়ে যাচ্ছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভাড়া পরিশোধ না করার সংকল্প নিয়েছেন। সাধারণত চুক্তি পালনীয় কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে চুক্তির দায়বদ্ধতা থেকে সাময়িকভাবে শিথিলতা পেতে আইনের সহায়তা খুঁজেছেন অনেকেই।
ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া না প্রদানের ন্যায্যতা বা যুক্তি প্রমাণের জন্য অতীতে আদালতে চুক্তি আইনের হতাশার নীতি (doctrine of frustration) বা ফোর্স মেজার (force majeure) অথবা খোদায়ী কর্ম (act of God) কে উপস্থাপন করা হয়েছে। আদালত অনেক ক্ষেত্রে যুক্তিকে গ্রহণ করেছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তিগুলোকে খন্ডন করেছেন। ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া না প্রদানের পরিনতি কি হতে পারে? আমাদের দেশে প্রচলিত চুক্তি আইন ১৮৭২ এর ধারা ৫৬ তে বর্ণিত হতাশার নীতি দ্যা ডক্ট্রিন অফ ফ্রাস্ট্রেশন এবং ঐতিহাসিক ও বিচার বিভাগীয় নজিরের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হলো।
ইতিহাস বলে ষোড়শ শতকে বৃটেনে গৃহযুদ্ধ চলাকালে ভাড়া বকেয়া সংক্রান্ত মামলা প্যারাডাইন বনাম জেইন (১৬৪৭) এ হাউস অফ লর্ডস চুক্তি সংক্রান্ত দেনার ক্ষেত্রে নিখুঁত দায়বদ্ধতা নীতি (absolute liability) প্রতিষ্ঠা করে। জনাব প্যারাডাইনের মালিকানাধীন একটি বাড়ি জনাব জেইন ভাড়া নেয়। গৃহযুদ্ধ চলাকালে রাজকীয় বাহিনী জেইনকে বিতাড়িত করে নিজেদের দখলে নেয়। জেইন প্রায় চার বছর সময়ের ভাড়া না প্রদান করার কারণে প্যারাডাইন আদালতে তার ভাড়াটিয়া জেইনের বিপক্ষে বকেয়া ভাড়া আদায়ের জন্য মামলা করে। বাড়িওয়ালার পক্ষে ভাড়া প্রদানের আদেশ দিয়ে আদালত বলে জনাব জেইন নিজ সৃষ্ট চুক্তির কারণে, দুর্ঘটনা সত্ত্বেও, এটি সম্পাদন করতে বাধ্য। আর প্রতিষ্ঠিত হয় নিখুঁত দায়বদ্ধতা নীতি।
এ নীতির সমালোচনা চলতে থাকে, সমাধান হয় ১৮৬৩ সালে কুইন্স বেঞ্চের একটি যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে। টেইলর বনাম ক্যাডওয়েল (১৮৬৩) মামলায় চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে অসম্ভবতার নীতি (doctrine of impossibility) প্রতিষ্ঠিত হয়। নিখুঁত দায়বদ্ধতা নীতিটি দুর্বল হয়ে যায় এবং সহজ হয় চুক্তি পালনে শিথিলতা। ক্যাডওয়েল এর মালিকানাধীন একটি মিউজিক হল ও বাগান টেইলর ভাড়া নেয় সংগীত পরিবেশন করার জন্য যাতে বহু লোকজন টিকেট কিনে অংশগ্রহণ করবে। কনসার্ট শুরু হওয়ার ১ সপ্তাহ পূর্বে মিউজিক হলটি ভেঙ্গে যায় এবং কনসার্ট আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। টেইলর মিউজিক হলের মালিক ক্যাডওয়েল এর বিপক্ষে মিউজিক হল ভাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করে। ঝড় ওঠে ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থায়। আদালত ক্যাডওয়েল এর পক্ষে রায় প্রদান করে বলে, এ চুক্তি পালন করা বাস্তবিক কারণে অসম্ভব হয়ে গেছে এবং প্রতিষ্ঠা করে অসম্ভবতার নীতি, উভয় পক্ষই তাদের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে লন্ডন এন্ড নর্দার্ন এস্টেট কোম্পানি বনাম সেসিঙ্গার, ১৯২২ সালে মেথি বনাম কার্লিং, ১৯৪৫ সালে ক্রিকেলউড প্রপার্টি ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট লিমিটেড বনাম লেইটন ইনভেস্টমেন্টস ট্রাস্ট লিমিটেড, ১৯৮১ সালে ন্যাশনাল কেরিয়ার লিমিটেড বনাম পানাল্পিনা ইত্যাদি বহু মামলায় অসম্ভবতার নীতি স্বীকৃত হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ কলোনিয় শাসন ব্যবস্থার অধীন, এখানকার চুক্তিসমূহ পরিচালনার জন্য ব্রিটিশরা বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন করে যা আজকের “চুক্তি আইন ১৮৭২” হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। এ আইনে অসম্ভবতার নীতি কে বিধিবদ্ধ মর্যাদা দেয়া হয়। ধারা ৫৬ অনুসারে চুক্তিকারী পক্ষসমূহের আওতার বাইরে, অন্য কোন কারণে, চুক্তি পালন করা অসম্ভব হলে, চুক্তিটি বাতিলযোগ্য বা বাতিল হতে পারে এবং উভয় পক্ষই দায়মুক্ত থাকতে পারে। এই ৫৬ ধারা ব্রিটিশ আইনের মূলনীতি ডকট্রিন অফ ইম্পসিবিলিটি, সিভিল (ফ্রান্স,জার্মানি, ইতালি) আইনের মূলনীতি ফোর্স মেজার (force majeure) এবং সাধারণভাবে গৃহীত খোদায়ী কর্ম (act of God) কে প্রতিফলিত করে যা আমাদের আইনে বিধিবদ্ধভাবে গৃহীত হয়েছে।
এই ধারা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রধান দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে প্রথমত: ঘটনাটি পক্ষসমূহের বাইরের কোনো কারণে ঘটেছে যা তাদের অনুমান ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল দ্বিতীয়তঃ উক্ত ঘটনার কারণেই চুক্তিটি পালন করা অসম্ভব হয়েছে। নতুবা আদালতে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এনার্জি ওয়াচডগ বনাম কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ২০১৭, যে মামলায় কয়লার দাম বৃদ্ধি কে ফোর্স মেজার এবং ৫৬ ধারার অধীনে অসম্ভবতার নীতি হিসেবে চিহ্নিত করার আবেদন পরে কিন্তু আদালত শুধু কয়লার দাম বাড়ানোকে অসম্ভবতার নীতি বা ফোর্স মেজার হিসেবে গ্রহণ করেনি। একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে নাভা পাওয়ার লিমিটেড বনাম পাঞ্জাব স্টেট পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড (২০১৭) এবং কাঞ্চন উদ্যোগ লিমিটেড বনাম ইউনাইটেড স্পিরিটস লিমিটেড (২০১৭)। ১৯৬৮ সালে রাজা ধ্রুব দেব চাঁদ বনাম রাজা হারমহিন্দার সিং মামলায়ও এই নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বনাম বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (২০১৭) মামলায় ফোর্স মেজার সম্পর্কে বলেছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড চুক্তি থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য ফরসিবিয়েলিটি টেস্ট পাশ করতে পারেনি যা পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে ফোর্স মেজার বলে ধারণা করা হয়েছিল। পরিস্থিতির পরিবর্তন বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির আওতায় ফোর্স মেজার বা চুক্তি আইনের অধীন উত্তরকালীন অসম্ভবতা বলে গণ্য হয় না । দাম বৃদ্ধি কে চুক্তি অনুযায়ী ৫৬ ধারার অধীনে সুফল দাবি করা যায় না । একই প্রয়োগ এইচআরসি শিপিং লিমিটেড বনাম এমবি এক্সপ্রেস মানসলু (২০০৬) মামলাতেও পরিলক্ষিত হয়।
বিশেষ করে বলতে গেলে ৫৬ ধারা বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দুইটি যুগান্তকারী রায় রয়েছে। ১৯৮৪ সালে আজিজুর রহমান বনাম আব্দুস সাকুর, ৩৬ ডিএলআর (এডি) ১৯৫ মামলায় চুক্তিকৃত বিষয়বস্তু সম্পূর্ণভাবে বা সিংহভাগ ধ্বংস হয়ে গেলে সেখানে চুক্তি আইনের অসম্ভবতার নীতি ৫৬ ধারা প্রয়োগ করা যাবে। ১৯৯৫ সালে মোঃ মকবুল হোসেন খন্দকার বনাম মোসাম্মৎ জাহেদা খাতুন, ১৫ বিএলডি (এডি) ১৮৫ মামলায়ও একই নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো করুণা ভাইরাস মহামারীর কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থা যার কারণে চুক্তি পালন করা অসম্ভব হচ্ছে, আদালতে ৫৬ ধারার শর্ত পূরণ করবে কিনা? কেউ যদি ভাড়া প্রদান বন্ধ করে দেয় তাহলে মালিক তার বিপক্ষে ভাড়া আদায়ের জন্য মামলা করে ভাড়া পাওয়ার অধিকারী হবে কিনা অথবা অন্য যেসব চুক্তির কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি সেগুলোর কোন চুক্তির অধীনে কোনো পক্ষ যদি তার কর্তব্য পালন বা দায়বধ্যতা থেকে সরে আসে তাহলে অন্য পক্ষ তাকে কর্তব্য পালন করার জন্য কিংবা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আদালতে সফল হবে কিনা? চুক্তির কোন শর্তে যদি এ ধরনের অসম্ভবতার নীতির বিষয়ে কিছু বলা না থাকে তাহলে সে চুক্তি গুলির কী হবে? এ ধরনের অসহায় অবস্থার কোনো আইনি সমাধান কি নেই? সাময়িকভাবে ব্যবহার অযোগ্য সম্পত্তির চুক্তির ব্যাপারে আইন কি কোন সমাধান দেয়?
করোনা ভাইরাস মহামারীকে ৫৬ ধারা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কিনা এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়। আমার মতে, চুক্তিকারী পক্ষসমূহ নিম্নোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করতে পারে।
১. চুক্তিতে বর্ণিত শর্তসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করে এর অধীনে এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে কিনা চিন্তা করতে পারে। চুক্তির দফা অনুসারে কোনো নোটিশ এর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায় কিনা বিবেচনা করতে পারে।
২. এ মহামারীতে ব্যবসায়িক ক্ষতির বিষয়ে পর্যালোচনা করে চুক্তিকারী পক্ষসমূহ নিজেদের মধ্যে যেকোনো দায় সীমিত করার ক্ষেত্রে সম্মতি দিতে পারে যা চুক্তি সংশোধনের মাধ্যমে সম্ভব। কিছু সময়ের জন্য ভাড়া প্রদানের শিথিলতা অথবা দেরিতে ভাড়া প্রদান করা অথবা ভাড়া কমানো সহ নানা পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। উভয় পক্ষের স্বার্থেই চুক্তির সমাপ্তি বা চুক্তিভঙ্গ কোনো সমাধান নয়।
৩. সাধারণভাবে ঘোষিত লকডাউন আইনের দৃষ্টিতে চুক্তি পালনে অক্ষমতার বিষয় সমূহ কী ভাবে বিবেচিত হবে তা বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করা।
আমরা সরকারি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে বাংলাদেশের সমস্ত চুক্তি সম্পর্কিত আইনি প্রভাবের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এমতাবস্থায় সরকারি সুস্পষ্ট নির্দেশনা/আইন /অধ্যাদেশ হাজারো চুক্তিকে রক্ষা করতে পারে এবং অতি শীঘ্রই উদ্ভূত হওয়া অনেক মামলা বা আইনি বিরোধ কমাতে সাহায্য করবে।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনী বিশ্লেষন ও শিক্ষামূলক লেখক এর ব্যক্তিগত অভিমত)
লেখক: অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সমন্বয়ক: বাংলাদেশ লিগ্যাল ইন্টারপ্রেটার এন্ড ট্রান্সলেটর সোসাইটি
ইমেইল: bnm.mir@gmail.com