এম. এ সাঈদ শুভ : ইদানিং মাঝেমধ্যেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে থাকি যে, মোবাইল কোর্ট যদি এখতিয়ার বহির্ভূত বা বেআইনী বা অসাংবিধানিক আদেশ প্রদান করে থাকেন তার বিরুদ্ধে প্রতিকার কি? এই লেখার মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই প্রশ্নটির ব্যাপারে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
প্রথমেই মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর বিধান দেখে নেয়া যাক। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ১৩ ধারায় এ সংক্রান্ত প্রতিকারের কথা বলা আছে। এই আইনের ধারা ১৩ (১) এ উল্লেখ আছে, “এই আইনের অধীন আরোপিত দণ্ড দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক অধিক্ষেত্রের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (ডিসি) এর নিকট আপীল দায়ের করিতে পারিবেন।”
১৩ (২) ধারায় বলা আছে, “ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিজে উক্ত আপীল শুনানী ও নিষ্পত্তি করিবেন অথবা তাঁহার অধীনস্থ যে কোন অতিরিক্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট উহা শুনানী ও নিষ্পত্তির জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন।”
১৩(৩) ধারা অনুযায়ী ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অতিরিক্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল সংশ্লিষ্ট অধিক্ষেত্রের দায়রা জজের নিকট দায়ের করিতে হইবে, এবং দায়রা জজ নিজে উক্ত আপীল শুনানী ও নিষ্পত্তি করিবেন কিংবা কোন অতিরিক্ত দায়রা জজের নিকট উক্ত আপীল শুনানী ও নিষ্পত্তির জন্য প্রেরণ করিবেন। উল্লেখ্য যে, জেলার ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) পধাদিকার বলে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
এবার ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৩৫, ৪৩৯ এবং ৪৩৯ক এর বিধানসমূহে আলোকপাত করা যাক। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৫ ধারা অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা জজ এর গোচরীভূত করতে পারবেন অথবা হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা জজ স্বপ্রনোদিত হয়ে মোবাইল কোর্টসহ যেকোনো নিম্ন আদালত প্রদত্ত কোনো অভিমত, শাস্তি বা আদেশের সঠিকতা, বৈধতা বা যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হইবার জন্য উক্ত আদালতের কোনো কার্যক্রমের নথি তলব করিতে ও পরীক্ষা করিতে পারিবেন, নথি তলবের সময় নির্দেশ দিতে পারিবেন যে, নথির পরীক্ষা সাপেক্ষে কোনো শাস্তি কার্যকরীকরণ স্থগিত থাকিবে এবং আসামী আটক থাকিলে তাহাকে জামিনে বা তাহার নিজের মুচলেখায় মুক্তি দিতে হবে। এই ধারায় আরো উল্লেখ আছে যে, সকল নির্বাহী বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এই ধারার উদ্দেশ্যপূরণকল্পে দায়রা জজের অধীনস্ত বলিয়া গণ্য হইবে। এক্ষেত্রে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারও (ডিসি) দায়রা জজের অধীনস্ত বলিয়া গণ্য হইবে।
এরপর হাইকোর্ট বিভাগ ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৩৯ অনুযায়ী এবং দায়রা জজ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৯ক ধারা অনুযায়ী, কোনো মামলার নথি তলব করিয়া থাকিলে বা অন্য কোনোভাবে বিষয়টি গোচরীভূত হইলে হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা জজ ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪২৩, ৪২৬, ৪২৭ এবং ৪২৮ অনুযায়ী আপীল আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগ করে কোনো আসামীর খালাস, দন্ড হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারবেন। তবে রিভিশন এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা জজের আপীল আদালতের তুলনায় দুটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা জজ রিভিশন এখতিয়ার প্রয়োগকালে কোনো দন্ডিত ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদান না করিয়া তাহার দন্ড বৃদ্ধি করিতে পারিবেন না। দ্বিতীয়ত, হাইকোর্ট বিভাগ এবং দায়রা জজ রিভিশন এখতিয়ার প্রয়োগকালে নিম্ন আদালত কর্তৃক কাউকে খালাস দেয়া হলে তাকে দন্ড প্রদান করিতে পারিবেন না।
এছাড়াও, কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন যে মোবাইল কোর্ট বা কোনো অধস্তন আদালত প্রদত্ত কোনো বেআইনী বা এখতিয়ার বহির্ভূত বা অসাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে ৪৩ এ বর্নিত কোনো একটি লঙ্গ্ঘিত হয়েছে তাহলে অন্য কোনো আইনে যাহাই থাকুক না কেনো উক্ত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর হাইকোর্ট বিভাগে উক্ত দন্ডাদেশ এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিট পিটিশন দায়ের করিতে পারবেন।
লেখক- বিচারক, জেলা জজ আদালত, রাজশাহী।
ইমেইল: sayeed.judge@gmail.com